পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে 86 বঙ্গসাহিত্যে একটি সাহসিক সৃষ্টি-উৎসাহের যুগ এসেছে। এই নব অভ্যুদয়ের অভিনন্দন করতে আমি কুষ্ঠিত হই নে । কিন্তু, শক্তির একটা নূতন স্মৃর্তির দিনেই শক্তিহীনের কৃত্রিমতা সাহিত্যকে আবিল ক’রে তোলে। সন্তরণপটু যেখানে অবলীলাক্রমে পার হয়ে যাচ্ছে, অপটুর দল সেইখানেই উদ্দাম ভঙ্গিতে কেবল জলের নীচেকার পাককে উপরে আলোড়িত করতে থাকে। অপটুই কৃত্রিমতা দ্বারা নিজের অভাব পূরণ করতে প্ৰাণপণে চেষ্টা করে ; সে রূঢ়তাকে বলে শৌর্য, নিলাৰ্জতাকে বলে পৌরুষ । বাধি গতের সাহায্য ছাড়া তার চলবার শক্তি নেই বলেই সে হাল-আমলের নূতনত্বেরও কতকগুলো বাধি বুলি ংগ্ৰহ ক’রে রাখে । বিলিতি পাকশালায় ভারতীয় কারির যখন নকল করে, শিশিতে কারি-পাউডার বাধা নিয়মে তৈরি করে রাখে ; যাতে-তাতে মিশিয়ে দিলেই পাঁচ মিনিটের মধ্যেই কারি হয়ে ওঠে; লঙ্কার গুড়ো বেশি থাকাতে তার দৈন্য বোঝা শক্ত হয় । আধুনিক সাহিত্যে সেইরকম শিশিতে-সাজানো বাধি বুলি আছে- অপটু লেখকদের পাকশালায় সেইগুলো হচ্ছে “রিয়ালিটির কারি-পাউডার । ওর মধ্যে একটা হচ্ছে দারিদ্র্যের আস্ফালন, আর-একটা লালসার অসংযম । অন্যান্য সকল বেদনার মতোই সাহিত্যে দারিদ্র্যবেদনারও যথেষ্ট স্থান আছে । কিন্তু ওটার ব্যবহার একটা ভঙ্গিমার অঙ্গ হয়ে উঠেছে ; যখন-তখন সেই প্ৰয়াসের মধ্যে লেখকেরই শক্তির দারিদ্র্য প্ৰকাশ পায় । আমরাই রিয়ালিটির সঙ্গে কারবার করে থাকি, আমরাই জানি কাকে বলে। লাইফ” এই আস্ফালন করবার ওটা একটা সহজ এবং চলতি প্রেসক্রিপশনের মতো হয়ে উঠছে। অথচ ঐদের মধ্যে অনেকেই দেখা যায় নিজেদের জীবনযাত্রায় দরিদ্র-নারায়ণের ভোগের ব্যবস্থা বিশেষ কিছুই রাখেন নি ; ভালোরকম উপার্জনও করেন, সুখে স্বচ্ছন্দেও থাকেন ; দেশের দারিদ্র্যকে এরা কেবল নব্যসাহিত্যের নূতনত্বের বঁাজ বাড়াবার জন্যে সর্বদাই ঝাল-মসলার মতো ব্যবহার করেন । এই ভাবুকতার কারি-পাউডারের যোগে একটা কৃত্রিম সস্তা সাহিত্যের সৃষ্টি হয়ে উঠছে। এই উপায়ে বিনা প্ৰতিভায় এবং অল্প শক্তিতেই বাহবা পাওয়া যায়, এইজন্যেই অপটু লেখকের পক্ষে এ একটা মস্ত প্ৰলোভন এবং অবিচারক পাঠকের পক্ষে একটা সাহিত্যিক অপথ্য । সাহিত্যে লালসা ইতিপূর্বে স্থান পায় নি বা এর পরে স্থান পাবে না, এমন কথা সত্যের খাতিরে বলতে পারি নে। কিন্তু, ও জিনিসটা সাহিত্যের পক্ষে বিপদজনক । বলা বাহুল্য, সামাজিক বিপদের কথাটা আমি তুলছি নে। বিপদের কারণটা হচ্ছে, ওটা অত্যন্ত সস্তা, ধুলোর উপরে শুয়ে পড়ার মতোই সহজসাধ্য। অর্থাৎ, ধুলোয় যার লুটােতে সংকোচ নেই তার পক্ষে একেবারেই সহজ । পাঠকের মনে এই আদিম প্রবৃত্তির উত্তেজনা সঞ্চার করা অতি অল্পেই হয়। এইজন্যেই, পাঠকসমাজে এমন একটা কথা যদি ওঠে যে, সাহিত্যে লালসাকে একান্ত উন্মথিত করাটাই আধুনিক যুগের একটা মস্ত ওস্তাদি, তা হলে এজন্যে বিশেষ শক্তিমান লেখকের দরকার হবে না- সাহস দেখিয়ে বাহাদুরি করবার নেশা যাদের লাগবে তারা এতে অতি সহজেই মেতে উঠতে পারবে । সাহসটা সমাজেই কী, সাহিত্যেই কী, ভালো জিনিস। কিন্তু, সাহসের মধ্যেও শ্রেণীবিচার, মূল্যবিচার আছে। কোনো-কিছুকে কেয়ার করি নে ব’লেই যে সাহস, তার চেয়ে বড়ো জিনিস হচ্ছে একটা-কিছুকে কেয়ার করি বলেই যে সাহস । মানুষের শরীর-ঘেষা যে-সব সংস্কার জীবসৃষ্টির ইতিহাসে সেইগুলো অনেক পুরোনো, প্ৰথম অধ্যায় থেকেই তাদের আরম্ভ । একটু ছুতে-না ছুতেই তারা ঝনঝনি ক’রেই বেজে ওঠে । মেঘনাদবধের নরকবর্ণনায় বীভৎস রসের অবতারণা উপলক্ষে মাইকেল এক জায়গায় বর্ণনা করেছেন, নারকী বামন ক’রে উদগীৰ্ণ পদার্থ আবার খাচ্ছে- এ বর্ণনায় পাঠকের মনে ঘূণা সঞ্চার করতে কবিত্বশক্তির প্রয়োজন করে না, কিন্তু আমাদের মানসিকতার মধ্যে যে-সব ঘূণ্যতার মূল তার প্রতি ঘূণা জাগিয়ে তুলতে কল্পনাশক্তির দরকার। ঘূণাবৃত্তির প্রকাশটা সাহিত্যে জায়গা পাবে না, এ কথা বলব না। কিন্তু সেটা যদি একান্তই একটা দৈহিক সন্তা জিনিস হয় তা হলে তাকে অবজ্ঞা করার অভ্যাসটাকে নষ্ট না করলেই ভালো হয় । তুচ্ছ ও মহন্তের, ভালো ও মন্দের কঁকার ও পদ্মের ভেদ অসীমের মধ্যে নেই, অতএব সাহিত্যেই বা