পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8VO রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী পারে। এই কারণে জগতে সকলের চেয়ে অরক্ষিত অসহায় জীব হল সাহিত্যরচয়িতা । মৃদুস্বভাব হরিণ পালিয়ে বঁাচে, কিন্তু কবি ধরা পড়ে ছাপার অক্ষরের কালো জালটায় । এ নিয়ে আপেক্ষ করে লাভ নেই ; নিজের অনিবাৰ্য কর্মফলের উপরে জোর খাটে না । , রুচির মার যখন খাই তখন চুপ করে সহ্য করাই ভালো, কেননা সাহিত্যরচয়িতার ভাগ্যচক্রের মধ্যেই রুচির কুগ্ৰহ-সুগ্রহের চিরনির্দিষ্ট স্থান । কিন্তু, বাইরে থেকে যখন আসে উল্কাবৃষ্টি, সম্মার্জনী হাতে আসে ধূমকেতু, আসে উপগ্রহের উপসৰ্গ, তখন মাথা চাপড়ে বলি, এ যে মারের উপরি-পাওনা । বাংলাসাহিত্যের অন্তঃপুরে শ্রেণীর যাচনদার বাহির হতে ঢুকে পড়েছে ; কেউ তাদের দ্বাররোধ করবার নেই। বাউলকবি দুঃখ করে বলেছে, ফুলের বনে জহুরী ঢুকেছে, সে পদ্মফুলকে নিকষে ঘষে ঘষে বেড়ায়, ফুলকে দেয় লজ্জা । আমরা সহজেই ভুলি যে, জাতিনির্ণয় বিজ্ঞানে, জাতির বিবরণ ইতিহাসে, কিন্তু সাহিত্যে ‘জাতিবিচার নেই, সেখানে আর-সমস্তই ভুলে ব্যক্তির প্রাধান্য স্বীকার ক’রে নিতে হবে । অমুক কুলীন ব্ৰাহ্মণ, এই পরিচয়েই অতি অযোগ্য মানুষও ঘরে ঘরে বরমাল্য লুটে বেড়াতে পারে, কিন্তু তাতে ব্যক্তি হিসাবে তার যোগ্যতা সপ্ৰমাণ হয় না । লোকটা কুলীন কি না কুলপঞ্জিকা দেখলেই সকলেই সেটা বলতে পারে, অথচ ব্যক্তিগত যোগ্যতা নির্ণয় করতে যে সমজদারের প্রয়োজন তাকে খুঁজে মেলা ভার। এইজন্যে সমাজে সাধারণত শ্রেণীর কাঠামোতেই মানুষকে বিভক্ত করে ; জাতিকুলের মর্যাদা দেওয়া, ধনের মর্যাদা দেওয়া সহজ । সেই বিচারেই ব্যক্তির প্রতি সর্বদাই সমাজে অবিচার ঘটে, শ্রেণীর বেড়ার বাইরে যোগ্যব্যক্তির স্থান অযোগ্যব্যক্তির পঙক্তির নীচে পড়ে। কিন্তু, সাহিতে্যু জগন্নাথের ক্ষেত্র ; এখানে জাতির খাতিরে ব্যক্তির অপমান চলবে না । এমন-কি, এখানে বর্ণসংকর দোযও দোষ নয় ; মহাভারতের মতোই উদারতা । কৃষ্ণদ্বৈপায়নের জন্ম-ইতিহাস নিয়ে এখানে কেউ র্তার সম্মান অপহরণ করে না ; তিনি তার নিজের মহিমাতেই মহীয়ান । অথচ আমাদের দেশে দেবমন্দির প্রবেশেও যেমন জাতিবিচারকে কেউ নাস্তিকতা মনে করে না, তেমনি সাহিত্যের সরস্বতীর মন্দিরের পাণ্ডারা দ্বারের কাছে কুলের বিচার করতে সংকোচ করে না । হয়তো বলে বসে, এ লেখাটার চাল কিংবা স্বভাব বিশুদ্ধ ভারতীয় নয়, এর কুলে যবনস্পর্শ দোষ আছে। দেবী ভারতী স্বয়ং এরকমের মেল-বন্ধন মানেন না, কিন্তু পাণ্ডারা এই নিয়ে তুমুল তর্ক তোলে। চৈন চিত্র-বিশ্লেষণে প্রমাণ হতে পারে যে, তার কোনো অংশে ভারতীয় বৌদ্ধ সংস্রব ঘটেছে ; কিন্তু সেটা নিছক ইতিহাসের কথা, সারস্বত বিচারের কথা নয় । সে চিত্রের ব্যক্তিত্বটি দেখো, যদি রূপব্যক্তিতায় কোনো দোষ না থাকে তা হলে সেইখানেই তার ইতিহাসের কলঙ্কভঞ্জন হয়ে গেল। মানুষের মনে মানুষের প্রভাব চারি দিক থেকেই এসে থাকে। যদি অযোগ্য প্রভাব নাহয় তবে তাকে স্বীকার করবার ও গ্রহণ করবার ক্ষমতা না থাকাই লজার বিষয়- তাতে চিত্তের নিজীবতা প্ৰমাণ হয় । নীল নদীর তীর থেকে বর্ষার মেঘ উঠে আসে। কিন্তু, যথাসময়ে সে হয় ভারতেরই বর্ষা । তাতে ভারতের ময়ুর যদি নেচে ওঠে তবে কোনো শুচিবায়ুগ্ৰস্ত স্বাদেশিক তাকে যেন ভৎসনা না.করেন ; যদি সে না নাচত তবেই বুঝতুম, ময়ুরটা মরেছে বুঝি । এমন মরুভূমি আছে যে সেই মেঘকে তিরস্কার ক’রে আপনি সীমানা থেকে বের করে দিয়েছে। সে মরু থাক আপনি বিশুদ্ধ শুচিতা নিয়ে একেবারে শুভ্ৰ আকারে, তার উপরে রসের বিধাতা শাপ দিয়ে রেখেছেন, সে কোনোদিন প্ৰাণবান হয়ে উঠবে না । বাংলাদেশেই এমন মন্তব্য শুনতে হয়েছে যে, দাশুরায়ের পাচলি শ্রেষ্ঠ, যেহেতু তা বিশুদ্ধ স্বাদেশিক । এটা অন্ধ অভিমানের কথা । এই অভিমানে একদিন শ্ৰীমতী বলেছিলেন, “কালো মেঘ। আর হেরব না গো দূতী ৷' অবস্থাবৈগুণ্যে এরকম মনের ভাব ঘটে। সে কথা স্বীকার করা যাক— ওটা হল খণ্ডিত নারীর মুখের কথা, মনের কথা নয় । কিন্তু, যখন তত্ত্বজ্ঞানী এসে বলেন, সাত্ত্বিকতা হল ভারতীয়ত্ব, রাজসিকতা হল যুরোপীয়ত্ব- এই বলে সাহিত্যে খানাতল্লাশি করতে থাকেন, লাইন চুনে চুনে রাজসিকতার প্রমাণ বের করে কাব্যের উপরে একঘরে করবার দাগ দিয়ে দেন, কাউকে জাতে রাখেন, কাউকে জাতে ঠেলেন, তখন একেবারে হতাশ হতে হয় ।