পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে 8S এক সময়ে ভারতীয় প্রভাব যখন প্রাণপূর্ণ ছিল তখন মধ্য এবং পূর্ব এশিয়া তার নিকট-সংস্পর্শে এসে দেখতে দেখতে প্ৰভূত শিল্পসম্পদে আশ্চর্যরূপে চরিতার্থ হয়েছিল। তাতে এশিয়ায় এনেছিল নবজাগরণ । এজন্য ভারতের বহির্বতী এশিয়ার কোনো অংশ যেন কিছুমাত্র লজিত না হয় । কারণ, যে-কোনো দানের মধ্যে শাশ্বত সত্য আছে তাকে যে-কোনো লোক যদি যথার্থভাবে আপন করে স্বীকার করতে পারে তবে সে দান সত্যই তার আপনার হয়। অনুকরণই চুরি, স্বীকরণ চুরি নয়। মানুষের সমস্ত বড়ো বড়ো সভ্যতা এই স্বীকরণশক্তির প্রভাবেই পূর্ণ মাহাত্ম্যলাভ করেছে। বর্তমান যুগে যুরোপ সর্ববিধ বিদ্যায় ও সর্ববিধ কলায় মহীয়ান। চারি দিকে তার প্রভাব নানা আকারে বিকীর্ণ। সেই প্রভাবের প্রেরণায় য়ুরোপের বহির্ভাগেও দেশে দেশে চিত্তজাগরণ দেখা দিয়েছে। এই জাগরণকে নিন্দা করা অবিমিশ্র মুঢ়তা । যুরোপ যে-কোনো সত্যকে প্ৰকাশ করেছে। তাতে সকল মানুষেরই অধিকার । কিন্তু, সেই অধিকারকে আত্মশক্তির দ্বারাই প্রমাণ করতে হয়তাকে স্বকীয় করে নিজের প্রাণের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া চাই। আমাদের স্বদেশানুভূতি, আমাদের সাহিত্য য়ুরোপের প্রভাবে উজ্জীবিত, বাংলাদেশের পক্ষে এটা গৌরবের কথা । শরৎ চাটুজের গল্প, বেতালপঞ্চবিংশতি হাতেমা-তাই গোলেবকাওয়ালী অথবা কাদম্বরী-বাসবদত্তার মতো যে হয় নি, হয়েছে য়ুরোপীয় কথাসাহিত্যের ছাদে, তাতে ক’রে অবাঙালিত্ব বা রজোগুণ প্রমাণ হয় না ; তাতে প্রমাণ হয় প্রতিভার প্রাণবত্তা । বাতাসে সত্যের যে প্রভাব ভেসে বেড়ায় তা দূরের থেকেই আসুক বা নিকটের থেকে, তাকে সর্বাগ্রে অনুভব করে এবং স্বীকার করে প্রতিভাসম্পন্ন চিত্ত ; যারা নিম্প্রতিভ তারাই সেটাকে ঠেকাতে চায় এবং যেহেতু তারা দলে ভারী এবং তাদের অসাড়তা ঘুচতে অনেক দেরি হয় এই কারণেই প্ৰতিভার ভাগ্যে দীর্ঘকাল দুঃখভোগ থাকে । তাই বলি, সাহিত্যবিচারকালে বিদেশী প্রভাবের বা বিদেশী প্রকৃতির খোটা দিয়ে বর্ণসংকরতা বা ব্রাত্যতার তর্ক যেন না তোলা হয়। আরো একটা শ্রেণীবিচারের কথা এই উপলক্ষে আমার মনে পড়ল । মনে পড়বার কারণ এই যে, কিছুদিন পূর্বেই আমার যোগাযোগ উপন্যাসের কুমুর চরিত্র সম্বন্ধে আলোচনা করে কোনো লেখিকা আমাকে পত্র লিখেছেন। তাতে বুঝতে পারা গেল, সাহিত্যে নারীকেও একটি স্বতন্ত্ৰ শ্রেণীতে দাড় করিয়ে দেখবার একটা উত্তেজনা সম্প্রতি প্ৰবল হয়ে উঠেছে। যেমন আজকাল তরুণ বয়স্কের দল হঠাৎ ব্যক্তির সীমা অতিক্রম করে দলপতিদের চাটুক্তির চোটে বিনামূল্যে একটা অত্যন্ত উচ্চ এবং বিশেষ শ্রেণীতে উত্তীৰ্ণ হয়ে গেছে, নারীদেরও সেই দশা । সাহিত্যের নারীতে নারীত্ব-নামক একটা শ্রেণীগত সাধারণ গুণ আছে কি না, এই তর্কটা সাহিত্যবিচারে প্রাধান্যলাভের চেষ্টা করছে । এরই ফলে কুমু ব্যক্তিগত ভাবে সম্পূর্ণ কুমু কি না। এই সাহিত্যসংগত প্রশ্নটা কারও কারও লেখনীতে বদলে গিয়ে দাড়াচ্ছে, কুমু মানবসমাজে নারী-নামক জাতির প্রতিনিধির পদ নিতে পারছে কি না- অর্থাৎ তাকে নিয়ে সমস্ত নারীপ্ৰকৃতি উৎকর্ষ স্থাপন করা হয়েছে কি না । মানবপ্রকৃতির যা-কিছু সাধারণ গুণ তারই প্ৰতি লক্ষ মনোবিজ্ঞানের, আর ব্যক্তিবিশেষের যে অনন্যসাধারণ প্রকৃতি তারই প্ৰতি লক্ষ সাহিত্যের । অবশ্য, এ কথা বলাই বাহুল্য, নারীকে আঁকতে গিয়ে তাকে অ-নারী করে আঁকা পাগলামি । বস্তুত, সে কথা আলোচনা করাই অনাবশ্যক । সাহিত্যে কুমুর যদি কোনো আদর হয় তো সে হবে সে ব্যক্তিগত কুমু ব’লেই, সে নারীশ্রেণীর প্রতিনিধি বলে নয়। কথা উঠেছে, সাহিত্যবিচারে বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতি শ্ৰদ্ধেয় কি না। এ প্রশ্নের উত্তর দেবার পূর্বে আলোচ্য এই-- কী সংগ্ৰহ করার জন্যে বিশ্লেষণ । আলোচ্য সাহিত্যের উপাদান-অংশগুলি ? আমি বলি সেটা অত্যাবশ্যক নয় ; কারণ, উপাদানকে একত্র করার দ্বারা সৃষ্টি হয় না। সমগ্ৰ সৃষ্টি আপন সমস্ত অংশের চেয়ে অনেক বেশি । সেই বেশিটুকু পরিমাণগত নয়। তাকে মাপা যায় না, ওজন করা যায় না, সেটা হল রূপরহস্য, সকল সৃষ্টির মূলে প্রচ্ছন্ন। প্রত্যেক সৃষ্টির মধ্যে সেটাই হল অদ্বৈত, বহুর মধ্যে সে ব্যাপ্ত অথচ বহুর দ্বারা তার পরিমাপ হয় না। সে স-কল অর্থাৎ তার মধ্যে সমস্ত অংশ আছে, তবু সে নিষ্কল, তাকে অংশে খণ্ডিত করলেই সে থাকে না । অতএব সাহিত্যে সমগ্রকে সমগ্ৰদূষ্টি দিয়েই দেখতে হবে । আজকাল সাইকো-অ্যানালিসিসের বুলি অনেকের মনকে পেয়ে বসে। সৃষ্টিতে