পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

89S রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী অবিশ্লেষ্য সমগ্রতার গীেরব খর্ব করবার মনোভাব জেগে উঠেছে। মানুষের চিত্তের উপকরণে নানাপ্রকার প্রবৃত্তি আছে, কাম ক্ৰোধ অহংকার ইত্যাদি। ছিন্ন করে দেখলে যে বস্তুপরিচয় পাওয়া যায় সম্মিলিত আকারে তা পাওয়া যায় না। প্রবৃত্তিগুলির গৃঢ় অস্তিত্ব দ্বারা নয়, সৃষ্টি প্রক্রিয়ার অভাবনীয় যোগসাধনের দ্বারাই চরিত্রের বিকাশ । সেই যোগের রহস্যকে আজকাল অংশের বিশ্লেষণ লঙ্ঘন করবার উপক্রম করছে। বুদ্ধদেবের চরিত্রের বিচিত্র উপাদানের মধ্যে কামপ্রবৃত্তিও ছিল, তার যৌবনের ইতিহাস থেকে সেটা প্রমাণ করা সহজ । যেটা থাকে সেটা যায় না, গেলে তাতে স্বভাবের অসম্পূর্ণতা ঘটে । চরিত্রের পরিবর্তন বা উৎকর্ষ ঘটে বর্জনের দ্বারা নয়, যোগের দ্বারা । সেই যোগের দ্বারা যৌ-পরিচয় সমগ্রভাবে প্রকাশমান সেইটেই হল বুদ্ধদেবের চরিত্রগত সত্য । প্রচ্ছন্নতার মধ্য থেকে বিশেষ উপকরণ টেনে বের করে তার সত্য পাওয়া যায় না । বিশ্লেষণে হীরকে অঙ্গারে প্রভেদ নেই, সৃষ্টির ইন্দ্ৰজালে আছে। সন্দেশে কার্বন আছে, নাইট্রোজেন আছে, কিন্তু সেই উপকরণের দ্বারা সন্দেশের চরম বিচার করতে গেলে বহুতর বিসদৃশ ও বিস্বাদ পদার্থের সঙ্গে তাকে এক শ্রেণীতে ফেলতে হয় ; কিন্তু এতে করেই সন্দেশের চরম পরিচয় আচ্ছন্ন হয় । কার্বন ও নাইট্রোজেন উপাদানের মধ্যে ধরা পড়া সত্ত্বেও জোর করে বলতে হবে যে, সন্দেশ পচা মাংসের সঙ্গে একশ্রেণীভুক্ত হতে পারে না । কেননা, উভয়ে উপাদানে এক কিন্তু প্ৰকাশে স্বতন্ত্র । চতুর লোক বলবে, প্রকাশটা চাতুরী ; তার উত্তরে বলতে হয়, বিশ্বজগৎটাই সেই চাতুরী । তা হােক, তবু রসভোগকে বিশ্লেষণ করা চলে । মনে করা যাক, আম । যে-ভাবে সেটা ভোগ্য সে-ভাবে উদ্ভিদবিজ্ঞানের সে অতীত । ভোগ সম্বন্ধে তার রমণীয়তা ব্যাখ্যা করবার উপলক্ষে বলা চলে যে, এই ফলে সাব-প্ৰথমে যেটা মনকে টানে সে হচ্ছে ওরা প্ৰাণের লাবণ্য ; এইখানে সন্দেশের চেয়ে তার শ্রেষ্ঠতা । আমের যে বর্ণমাধুরী তা জীববিধাতার প্রেরণায় আমের অন্তর থেকে উদ্ভাসিত, সমস্ত ফলটির সঙ্গে সে অবিচ্ছেদে এক । চোখ ভোলাবার জন্যে সন্দেশে জাফরান দিয়ে রঙ ফলানো যেতে পারে ; কিন্তু সেটা জড়পদার্থের বর্ণযোজন, প্ৰাণপদার্থের বর্ণ-উদ্ভাবনা নয় । তার সঙ্গে আমের আছে স্পর্শের সীেকুমাৰ্য, সৌরভের সৌজন্য। তার পরে তার আচ্ছাদন উদঘাটন করলে প্ৰকাশ পায় তার রসের অকৃপণতা । এইরূপে আম সম্বন্ধে রসভোগের বিশেষত্বটিকে বুঝিয়ে বলাকে বলব আমের রসবিচার। এইখানে স্বদেশিক এসে পরিচয়পত্রে বলতে পারেন, আম প্রকৃত ভারতবষীয়, সেটা ওর প্রচুর ত্যাগের দাক্ষিণ্যমূলক সাত্ত্বিকতায় প্রমাণ হয় ; আর র্যাসপবেরি গুসবেরি বিলাতি, কেননা তার রসের ভাগ তার বীজের ভাগের চেয়ে বেশি নয়, পরের তুষ্টির চেয়ে ওরা আপন প্রয়োজনকেই বড়ো করেছে, অতএব ওরা রাজসিক । এই কথাটা দেশাত্মবোধের অনুকূল কথা হতে পারে ; কিন্তু, এইরকমের অমূলক কি সমূলক তত্ত্বালোচনা রসশাস্ত্ৰে সম্পূর্ণই অসংগত । সংক্ষেপে আমার কথাটা দাড়ালো এই- সাহিত্যের বিচার হচ্ছে সাহিত্যের ব্যাখ্যা, সাহিত্যের বিশ্লেষণ নয়। এই ব্যাখ্যা মুখ্যত সাহিত্যবিষয়ের ব্যক্তিকে নিয়ে, তার জাতিকুল নিয়ে নয়। অবশ্য সাহিত্যের ঐতিহাসিক বিচার কিংবাতাত্ত্বিক বিচার হতে পারে । সেরকম বিচারে শাস্ত্রীয় প্রয়োজন থাকতে পারে, কিন্তু তার সাহিত্যিক প্রয়োজন নেই । কার্তিক ১৩৩৬