পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে BVO) আধুনিক কাব্য মডারন বিলিতি কবিদের সম্বন্ধে আমাকে কিছু লিখতে অনুরোধ করা হয়েছে। কাজটা সহজ নয় । কারণ, পাজি মিলিয়ে মডারনের সীমানা নির্ণয় করবে। কে । এটা কালের কথা ততটা নয় যতটা ভাবের কথা । ጶ" الد নদী সামনের দিকে সোজা চলতে চলতে হঠাৎ বাক ফেরে। সাহিত্যও তেমনি বরাবর সিধে চলে না। যখন সে বঁাক নেয়। তখন সেই বাকটাকেই বলতে হবে মডােরন। বাংলায় বলা যাক আধুনিক । এই আধুনিকটা সময় নিয়ে নয়, মর্জি নিয়ে । বাল্যকালে যে ইংরেজি কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় হল তখনকার দিনে সেটাকে আধুনিক বলে গণ্য করা চলত। কাব্য তখন একটা নতুন বঁাক নিয়েছিল, কবি বারনাস থেকে তার শুরু । এই ঝোকে একসঙ্গে অনেকগুলি রড়ো বড়ো কবি দেখা দিয়েছিলেন । যথা ওয়ার্ডস্বর্থ কোলরিজ শেলি কীটস। সমাজে সর্বসাধারণের প্রচলিত ব্যবহার রীতিকে আচার বলে । কোনো কোনো দেশে এই আচার ব্যক্তিগত অভিরুচির স্বাতন্ত্র্য ও বৈচিত্র্যাকে সম্পূর্ণ চাপা দিয়ে রাখে। সেখানে মানুষ হয়ে ওঠে পুতুল, তার চালচলন হয় নিখুঁত কেতা-দুরন্ত । সেই সনাতন অভ্যস্ত চালকেই সমাজের লোকে খাতির করে। সাহিত্যকেও এক-এক সময়ে দীর্ঘকাল আচারে পেয়ে বসে-রচনায় নিখুঁত রীতির ফোটাতিলক কেটে চললে লোকে তাকে বলে সাধু। কবি বারুনসের পরে ইংরেজি কাব্যে যে যুগ এল সে-যুগে রীতির বেড়া ভেঙে মানুষের মর্জি এসে উপস্থিত । ‘কুমুদকহলারসেবিত সরোবর’ হচ্ছে সাধু-কারখানায় তৈরি সরকারি ঠলির বিশেষ ছিদ্র দিয়ে দেখা সরোবর। সাহিত্যে কোনো সাহসিক সেই ঠুলি খুলে ফেলে, বুলি সরিয়ে, পুরো চোখ দিয়ে যখন সরোবর দেখে তখন ঠুলির সঙ্গে সঙ্গে সে এমন একটা পথ খুলে দেয় যাতে করে সরোবর নানা দৃষ্টিতে নানা খেয়ালে নানাবিধ হয়ে ওঠে । সাধু বিচারবুদ্ধি তাকে বলে, ধিক আমরা যখন ইংরেজি কাব্য পড়া শুরু করলুম। তখন সেই আচার-ভাঙা ব্যক্তিগত মার্জিকেই সাহিত্য স্বীকার করে নিয়েছিল। এডিনবরা রিভিয়ুতে যে-তর্জনধ্বনি উঠেছিল সেটা তখন শান্ত । যাই হােক, আমাদের সেকাল আধুনিকতার একটা যুগান্তকাল । তখনকার কালে কাব্যে আধুনিকতার লক্ষণ হচ্ছে ব্যক্তিগত খুশির দীেড়। ওয়ার্ডস্বর্থ বিশ্বপ্রকৃতিতে যে আনন্দময় সত্তা উপলব্ধি করেছিলেন সেটাকে প্রকাশ করেছিলেন নিজের ছাদে । শেলির ছিল প্ল্যাটােনিক ভাবুকতা, তার সঙ্গে রাষ্ট্রগত ধর্মগত সকলপ্রকার স্কুল বাধার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। রূপসৌন্দর্যের ধ্যান ও সৃষ্টি নিয়ে কীটুসের কাব্য। ঐ যুগে বাহ্যিকতা থেকে আন্তরিকতার দিকে কাব্যের স্রোত বাক ফিরিয়েছিল । কবিচিত্তে যে-অনুভূতি গভীর, ভাষায় সুন্দর রূপ নিয়ে সে আপনি নিত্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় । প্ৰেম আপনাকে সজ্জিত করে । অন্তরে তার যে আনন্দ বাইরে সেটাকে সে প্রমাণ করতে চায় সৌন্দর্যে। মানুষের একটা কাল গেছে। যখন সে অবসর নিয়ে নিজের সম্পৰ্কীয় জগৎটাকে নানারকম করে সাজিয়ে তুলত । বাইরের সেই সজাই তার ভিতরের অনুরোগের প্রকাশ। যেখানে অনুরাগ সেখানে উপেক্ষা থাকতে পারে না । সেই যুগে নিত্যব্যবহার্য জিনিসগুলিকে মানুষ নিজের রুচির আনন্দে বিচিত্র করে তুলেছে। অন্তরের প্রেরণা তার আঙুলগুলিকে সৃষ্টিকুশলী করেছিল। তখন দেশে দেশে গ্রামে গ্রামে ঘটিবাটি গৃহসজা দেহসজা রঙে রাপে মানুষের হৃদয়কে জড়িয়ে দিয়েছিল তার বহিরুপকরণে। মানুষ কত অনুষ্ঠান সৃষ্টি করেছিল জীবনযাত্রাকে রস দেবার জন্যে। কত নুতন নূতন সুর ; কাঠে ধাতুতে মাটিতে পাথরে রেশমে পশমে তুলোয় কত নূতন নূতন শিল্পকলা । সেই যুগে স্বামী তার স্ত্রীর পরিচয় দিয়েছে, প্রিয়শিষ্যাললিতে কলাবিধৌ । যে দাম্পত্যসংসার রচনা করত। তার , রচনাকার্যের জন্য ব্যান্তে জমানো টাকাটাই প্রধান জিনিস ছিল না, তার চেয়ে প্রয়োজন ছিল ললিতকলার । যেমন- তেমন করে মালা গাথলে চলত না ; চীনাংশুকের অঞ্চল প্রান্তে চিত্ৰবয়ন জানত।