পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে 8Գ Տ) আপনাকেই বোধ করাকে বলে অনুভব করা । সেইজন্যে উপনিষদ বলেছেন, পুত্ৰকে কামনা করি বলেই যে পুত্র আমাদের প্রিয় তা নয়, আপনাকেই কামনা করি বলেই পুত্র আমাদের প্ৰিয় । পুত্রের মধ্যে পিতা নিজেকেই উপলব্ধি করে, সেই উপলব্ধিতেই আনন্দ । আমরা যাকে বলি সাহিত্য, বলি ললিতকলা, তার লক্ষ্য এই উপলব্ধির আনন্দ, বিষয়ের সঙ্গে বিষয়ী এক হয়ে যাওয়াতে যে-আনন্দ । অনুভূতির গভীরতা দ্বারা বাহিরের সঙ্গে অন্তরের একাত্মবোধ যতটা সত্য হয়। সেই পরিমাণে জীবনে আনন্দের সীমানা বেড়ে চলতে থাকে, অর্থাৎ নিজেরই সত্তার সীমানা । প্রতিদিনের ব্যবহারিক ব্যাপারে ছোটো ছোটাে ভাগের মধ্যে আমাদের আত্মপ্রসারণকে অবরুদ্ধ করে, মনকে বেঁধে রাখে বৈষয়িক সংকীর্ণতায়, প্রয়োজনের সংসারটা আমাদের আপনাকে ঘিরে রাখে কড়া পাহারায় ; অবরোধের নিত্য অভ্যাসের জড়তায় ভুলে যাই যে, নিছক বিষয়ী মানুষ অত্যন্তই কম মানুষ- সে প্রয়োজনের কঁচি-ছটা মানুষ । প্ৰয়োজনের দাবি প্ৰবল এবং তা অসংখ্য । কেননা, যতটা আয়োজন আমাদের জরুরি তা আপন পরিমাণ রক্ষা করে না । অভাবমোচন হয়ে গেলেও তৃপ্তিহীন কামনা হাত পেতে থাকে ; সঞ্চায়ের ভিড় জমে, সন্ধানের বিশ্রাম থাকে না । সংসারের সকল বিভাগেই এই যে ‘চাই-চাই-এর হাট বসে গেছে, ত্ররই আশেপাশে মানুষ একটা ফাক খোজে যেখানে তার মন বলে চাই নে, অর্থাৎ এমন কিছু চাই নে যেটা লাগে সঞ্চায়ে । তাই দেখতে পাই প্রয়োজনের এত চাপের মধ্যেও মানুষ অপ্রয়োজনের উপাদান এত প্ৰভূত করে তুলেছে, অপ্রয়োজনের মূল্য তার কাছে এত বেশি। তার গৌরব সেখানে, ঐশ্বৰ্য সেখানে, যেখানে সে প্রয়োজনকে ছাড়িয়ে গেছে । বলা বাহুল্য, বিশুদ্ধ সাহিত্য অপ্রয়োজনীয় ; তার যে-রস সে অহৈতুক । মানুষ সেই দায়মুক্ত বৃহৎ অবকাশের ক্ষেত্রে কল্পনার সোনার-কাঠি-ছোওয়া সামগ্ৰীকে জাগ্রত করে জানে আপনারই সত্তায় । তার সেই অনুভবে অর্থাৎ আপনারই বিশেষ উপলব্ধিতে তার আনন্দ । এই আনন্দ দেওয়া ছাড়া সাহিত্যের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে বলে জানি নে । লোকে বলে, সাহিত্য যে আনন্দ দেয় সেটা সৌন্দর্যের আনন্দ । সে কথা বিচার ক’রে দেখবার যোগ্য । সৌন্দর্যরহস্যকে বিশ্লেষণ করে ব্যাখ্যা করবার অসাধ্য চেষ্টা করব না । অনুভূতির বাইরে দেখতে পাই, সৌন্দর্য অনেকগুলি তথ্যমাত্রকে অর্থাৎ ফ্যাকটুসকে অধিকার করে আছে। সেগুলি সুন্দরও নয়, অসুন্দরও নয়। গোলাপের আছে বিশেষ আকার-আয়তনের কতকগুলি পাপড়ি, বেঁটা ; তাকে ঘিরে আছে সবুজ পাতা । এই সমস্তকে নিয়ে বিরাজ করে এই সমস্তের অতীত একটি ঐক্যতত্ত্ব, তাকে বলি সৌন্দর্য। সেই ঐক্য উদবোধিত করে তাকেই যে আমার অন্তরতম ঐক্য, যে আমার ব্যক্তিপুরুষ। অসুন্দর সামগ্ৰীরও প্রকাশ আছে, সেও একটা সমগ্ৰতা, একটা ঐক্য, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু, তার বস্তুরূপী তথ্যটাই মুখ্য, ঐক্যটা গৌণ। গোলাপের আকারে আয়তনে, তার সুষমায়, তার অঙ্গপ্ৰত্যঙ্গের পরস্পর সামঞ্জস্যে, বিশেষভাবে নির্দেশ করে দিচ্ছে তার সমগ্রের মধ্যে পরিব্যাপ্ত এককে ; সেইজন্যে গোলাপ আমাদের কাছে কেবল একটি তথ্যমাত্র নয়, সে সুন্দর । কিন্তু শুধু সুন্দর কেন, যে-কোনো পদার্থই আপন তথ্যমাত্রাকে অতিক্রম করে সে আমার কাছে তেমনি সত্য হয়। যেমন সত্য আমি নিজে । আমি নিজেও সেই পদার্থ যা বহু তথ্যকে আবৃত করে See akt উচ্চ-অঙ্গের গণিতের মধ্যে যে-একটি গভীর সীেষম্য, যে-একটি ঐক্যরূপ আছে, নিঃসন্দেহ গাণিতিক তার মধ্যে আপনাকে নিমগ্ন করে । তার সামঞ্জস্যের তথ্যটি শুধু জ্ঞানের নয়, তা নিবিড় অনুভূতির ; তাতে বিশুদ্ধ আনন্দ । কারণ, জ্ঞানের যে উচ্চ শিখরে তার প্রকাশ সেখানে সে সর্বপ্রকার প্রয়োজন নিরপেক্ষ, সেখানে জ্ঞানের মুক্তি । এ কেন কাব্যসাহিত্যের বিষয় হয় নি এ প্রশ্ব স্বভাবতই মনে আসে । হয় নি যে তার কারণ এই যে, এর অভিজ্ঞতা অতি অল্প লোকের মধ্যে বন্ধ , এ সর্বসাধারণের অগোচর ; যে-ভাষার যোগে এর পরিচয় সম্ভব তা পারিভাবিক, বহু লোকের হৃদয়বোধের স্পর্শের দ্বারা সে সজীব উপাদােনরূপে গড়ে ওঠে নি। যে ভাবা হৃদয়ের মধ্যে অব্যবহিত