পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8Գ8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী আবেগে প্ৰবেশ করতে পারে না সে-ভাষায় সাহিত্যরসের সাহিত্যরূপের সৃষ্টি সম্ভব নয় । অথচ আধুনিক কাব্যে সাহিত্যে কলকারখানা স্থান নিতে আরম্ভ করেছে। যন্ত্রের বিশেষ প্রয়োজনগত তথ্যকে ছাড়িয়ে তার একটা বিরাট শক্তিরূপ আমাদের কল্পনায় প্রকাশ পেতে পারে, সে আপন অন্তনিহিত সুঘটিত সুসংগতিকে অবলম্বন করে আপনি উপাদানকে ছাড়িয়ে আবির্ভূত। কল্পনাদৃষ্টিতে তার অঙ্গপ্ৰত্যঙ্গের গভীরে যেন তার একটি আত্মস্বরাপকে প্ৰত্যক্ষ করা যেতে পারে । সেই আত্মস্বরূপ আমাদেরই ব্যক্তিস্বরূপের দোসর। যে-মানুষ তাকে, যান্ত্রিক জ্ঞানের দ্বারা নয়, অনুভূতির দ্বারা একান্ত বোধ করে সে তার মধ্যে আপনাকে পায়, কলের জাহাজের কাপ্তেন কলের জাহাজের অন্তরে যেমন পরম অনুরাগে আপনি ব্যক্তিপুরুষকে অনুভব করতে পারে। কিন্তু, প্রাকৃতিক নির্বাচন বা যোগাতমের উদবর্তন-তত্ত্ব এ জাতের নয় । এ-সব তত্ত্ব জানার দ্বারা নিষ্কাম আনন্দ হয় না তা নয়। কিন্তু, সে আনন্দটি হওয়ার আনন্দ নয়, তা পাওয়ার আনন্দ ; অর্থাৎ এই জ্ঞান জ্ঞানীর থেকে পৃথক, এ তার ব্যক্তিগত সত্তার অন্দর-মহলের জিনিস নয়, ভাণ্ডারের জিনিস । আমাদের অলংকারশাস্ত্ৰে বলেছে, বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম। সৌন্দর্যের রস আছে ; কিন্তু এ কথা বলা চলে না যে, সব রসেরই সৌন্দৰ্য আছে। সৌন্দর্যরসের সঙ্গে অন্য সকল রসেরই মিল হচ্ছে ঐখানে, যেখানে সে আমাদের অনুভূতির সামগ্ৰী । অনুভূতির বাইরে রসের কোনো অর্থই নেই। রসমােত্রই তথ্যকে অধিকার করে তাকে অনির্বচনীয় ভাবে অতিক্রম করে । রসপদাৰ্থ বস্তুর অতীত এমন একটি ঐক্যবোধ যা আমাদের চৈতন্যে মিলিত হতে বিলম্ব করে না । এখানে তার প্রকাশ আর আমার প্রকাশ একই কথা । বস্তুর ভিড়ের একান্ত আধিপত্যকে লাঘব করতে লেগেছে মানুষ । সে আপন অনুভূতির জন্যে অবকাশ রচনা করছে। তার একটা সহজ দৃষ্টান্ত দিই। ঘাঁড়ায় ক’রে সে জল আনে, এই জল আনায় তার নিত্য প্রয়োজন । অগত্যা বস্তুর দৌরাত্ম্য তাকে কাখে করে মাথায় করে বইতেই হয় । প্রয়োজনের শাসনই যদি একমাত্র হয়ে ওঠে তা হলে ঘড়া হয় আমাদের অনামীয় । মানুষ তাকে সুন্দর ক'রে গড়ে তুলল। জল বহনের জন্য সৌন্দর্যের কোনো অর্থই নেই। কিন্তু, এই শিল্পসৌন্দর্য প্রয়োজনের রাঢ়তার চারি দিকে ফাঁকা এনে দিল । যে-ঘড়াকে দায়ে পড়ে মেনেছিলেম, নিলেম তাকে আপন করে । মানুষের ইতিহাসে আদিম যুগ থেকেই এই চেষ্টা । প্রয়োজনের জিনিসকে সে অপ্রয়োজনের মূল্য দেয়, শিল্পকলার সাহায্যে বস্তুকে পরিণত করে বস্তুর অতীতে । সাহিত্যসৃষ্টি শিল্পীসৃষ্টি সেই প্ৰলয়লোকে যেখানে দায় নেই, ভার নেই, যেখানে উপকরণ মায়া, তার ধ্যানরূপটাই সত্য, যেখানে মানুষ আপনাতে সমস্ত আত্মসাৎ করে আছে। কিন্তু, বস্তুকে দায়ে পড়ে মেনে নিয়ে তার কাছে মাথা হেঁট করা কাকে বলে যদি দেখতে চাও তবে ঐ দেখো কেরোসিনের টিনে ঘটস্থাপনা, বাকের দুই প্রান্তে টিনের ক্যানেক্সা বেঁধে জল আনা । এতে অভাবের কাছেই মানুষের একান্ত পরাভব । যে মানুষ সুন্দর ক'রে ঘাড়া বানিয়েছে সে-ব্যক্তি তাড়াতাড়ি জলপিপাসাকেই মেনে নেয় নি, সে যথেষ্ট সময় নিয়েছে নিজের ব্যক্তিত্বকে মানতে । বস্তুর পৃথিবী ধূলোমাটি পাথর লোহায় ঠাসা হয়ে পিণ্ডীকৃত। বায়ুমণ্ডল তার চার দিকে বিরাট অবকাশ বিস্তার করেছে। এরই পরে তার আত্মপ্রকাশের ভূমিকা। এইখান থেকে প্ৰাণের নিশ্বাস বহমান ; সেই প্ৰাণ অনির্বচনীয় । সেই প্ৰাণশিল্পকারের তুলি এইখান থেকেই আলো নিয়ে, রঙ নিয়ে, তাপ নিয়ে, চলমান চিত্রে বার বার ভরে দিচ্ছে পৃথিবীর পট । এইখানে পৃথিবীর লীলার দিক, এইখানে তার সৃষ্টি ; এইখানে তার সেই ব্যক্তিরাপের প্রকাশ যাকে বিশ্লেষণ করা যায় না, ব্যাখ্যা করা যায় না ; যার মধ্যে তার বাণী, তার যাথার্থ, তার রস, তার শ্যামলতা, তার হিল্লোল। মানুষও নানা জরুরি কাজের দায় পেরিয়ে চায় আপন আকাশমণ্ডল যেখানে তার অবকাশ, যেখানে বিনা প্রয়োজনের লীলায় আপন সৃষ্টিতে আপনাকে প্রকাশই তার চরম লক্ষ্য- যে-সৃষ্টিতে জানা নয়, পাওয়া নয়, কেবল হওয়া । পূর্বেই বলেছি, অনুভব মানেই হওয়া । বাহিরের সত্তার অভিঘাতে সেই হওয়ার বোধে বান ডেকে এলে মন সৃষ্টিলীলায় উদবোল হয়ে ওঠে । আমাদের হৃদয়বোধের কাজ আছে জীবিকানিৰ্বাহের