পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে 8Գ (? প্রয়োজনে । আমরা আত্মরক্ষা করি, শক্র হনন করি, সন্তান পালন করি ; আমাদের হৃদয়বৃত্তি সেই সকল কাজে বেগ সঞ্চার করে, অভিরুচি জাগায়। এই সীমাটুকুর মধ্যে জন্তুর সঙ্গে মানুষের প্ৰভেদ নেই। প্রভেদ ঘটেছে সেইখানেই যেখানে মানুষ আপন হৃদয়ানুভূতিকে কর্মের দায় থেকে স্বতন্ত্র করে নিয়ে কল্পনার সঙ্গে যুক্ত করে দেয়, যেখানে অনুভূতির রসাটুকুই তার নিঃস্বাৰ্থ উপভোগের লক্ষ্য, যেখানে আপন অনুভূতিকে প্রকাশ করবার প্রেরণায় ফললাভের অত্যাবশ্যকতাকে সে বিস্মৃতি হয়ে যায় । এই মানুষই যুদ্ধ করবার উপলক্ষে কেবল অস্ত্ৰচালনা করে না, যুদ্ধের বাজনা বাজায়, যুদ্ধের নাচ নাচে । তার হিংস্ৰতা যখন নিদারুণ ব্যবসায়ে প্রস্তুত তখনো সেই হিংস্রতার অনুভূতিকে ব্যবহারের উর্ধেব নিয়ে গিয়ে তাকে অনাবশ্যক রূপ দেয় । হয়তো সেটা তার সিদ্ধি লাভে ব্যাঘাত করতেও পারে । শুধু নিজের সৃষ্টিতে নয়, বিশ্বসৃষ্টিতে সে আপন অনুভূতির প্রতীক খুঁজে বেড়ায় । তার ভালোবাসা ফেরো ফুলের বনে, তার ভক্তি তীর্থযাত্রা করতে বেরোয় সাগরসংগমে পর্বতশিখরে । সে আপন ব্যক্তিরাপের দোসরকে পায় বস্তুতে নয়, তত্ত্বে নয় ; লীলাময়কে সে পায় আকাশ যেখানে নীল, শ্যামল যেখানে নবদুর্বাদল। ফুলে যেখানে সৌন্দর্য, ফলে যেখানে মধুরতা, জীবের প্রতি যেখানে আছে করুণা, ভুমার প্রতি যেখানে আছে আত্মনিবেদন, সেখানে বিশ্বের সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত সম্বন্ধের চিরন্তন যোগ অনুভব করি হৃদয়ে। একেই বলি বাস্তব, যে বাস্তবে সত্য হয়েছে আমার আপনি । যেখানে আমরা এই আপনাকে প্রকাশের জন্য উৎসুক, যেখানে আমরা আপনের মধ্যে অপরিমিতকে উপলব্ধি করি সেখানে আমরা অমিতব্যয়ী, কী অর্থে কী সামর্থ্যে । যেখানে অর্থকে চাই অর্জন করতে সেখানে প্ৰত্যেক সিকি পয়সার হিসাব নিয়ে উদবিগ্ন থাকি ; যেখানে সম্পদকে চাই প্ৰকাশ করতে সেখানে নিজেকে দেউলে ক’রে দিতেও সংকোচ নেই । কেননা, সেখানে সম্পদের প্রকাশে আপনি ব্যক্তিপুরুষেরই প্ৰকাশ। বস্তুত, “আমি ধনী” এই কথাটি উপযুক্তরূপে ব্যক্ত করবার মতো ধন পৃথিবীতে কারও নেই। শত্রুর হাত থেকে প্রাণরক্ষা যখন আমাদের উদ্দেশ্য তখন দেহের প্ৰত্যেক চাল প্ৰত্যেক ভঙ্গি সম্বন্ধে নিরতিশয় সাবধান হতে হয় ; কিন্তু, যখন নিজের সাহসিকতা প্রকাশই উদ্দেশ্য তখন নিজের প্রাণপাত পর্যন্ত সম্ভব, কেননা এই প্রকাশে ব্যক্তিপুরুষের প্রকাশ । প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় আমরা খরচা করি বিবেচনাপূর্বক, উৎসবের সময় যখন আপনার আনন্দকে প্ৰকাশ করি তখন তহবিলের সসীমতা সম্বন্ধে বিবেচনাশক্তি বিলুপ্ত হয়ে যায়। কারণ, যখন আমরা আপন ব্যক্তিসত্তা সম্বন্ধে প্রবলরাপে সচেতন হই, সাংসারিক তথ্যগুলোকে তখন গণ্যই করি নে। সাধারণত মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে আমরা পরিমাণ রক্ষা করেই চলি । কিন্তু, যাকে ভালোবাসি অর্থাৎ যার সঙ্গে আমার ব্যক্তিপুরুষের পরম সম্বন্ধ তার সম্বন্ধে পরিমাণ থাকে না । তার সম্বন্ধে অনায়াসেই বলতে পারি।-- জনম অবধি হম রূপ নেহারানু, নয়ন নাতিরাপিত ভেল । লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখানু, তবু হিয়া জুড়েন না গেল । তথ্যের দিক থেকে এতবড়ো অদ্ভুত অত্যুক্তি আর-কিছু হতে পারে না, কিন্তু ব্যক্তিপুরুষের অনুভূতির মধ্যে ক্ষণকালের সীমায় সংহত হতে পারে চিরকাল । ‘পাষাণ মিলায়ে যায় গায়ের বাতাসে বস্তুজগতে এ কথাটা অতথ্য, কিন্তু ব্যক্তিজগতে তথ্যের খাতিরে এর চেয়ে কম করে যা বলতে যাই তা সত্যে পৌঁছয় না । বিশ্বসৃষ্টিতেও তাই। সেখানে বস্তু বা জাগতিক শক্তির তথ্য হিসাবে কড়াক্রান্তির। এদিকে-ওদিক হবার জো নেই। কিন্তু, সৌন্দর্য তথ্যসীমা ছাপিয়ে ওঠে ; তার হিসাবের আদর্শ নেই, পরিমাণ নেই। উৰ্ব্ব-আকাশের বায়ুস্তরে ভাসমান বাষ্পপুঞ্জ একটা সামান্য তথ্য, কিন্তু উদয়ান্তকালের সূর্যরশ্মির স্পর্শে তার মধ্যে যে অপরাপ বৰ্ণলীলার বিকাশ হয় সে অসামান্য, সে ‘ধূমজ্যোতিঃসলিলমারুতাং সন্নিপাতঃ’ মাত্র নয়, সে যেন প্রকৃতির একটা অকারণ অত্যক্তি, একটা পরিমিত বস্তুগত সংবাদ-বিশেষকে সে যেন একটা অপরিমিত অনির্বাচনীয়তায় পরিণত করে দেয় । ভাষার মধ্যেও যখন প্রবল অনুভূতির সংঘাত লাগে তখন তা শব্দার্থের আভিধানিক সীমা লঙঘন করে । > SRI | MSDS