পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

89 V ' ब्रीका-ाbादी এইজন্যে সে যখন বলে “চরণনখরে পড়ি দশ চাদ কঁাদে, তখন তাকে পাগলামি বলে উড়িয়ে দিতে পারি। নে । এইজন্য সংসারের প্রাত্যহিক তথ্যকে একান্ত যথাযথভাবে আর্টের বেদির উপরে চড়ালে তাকে লজা দেওয়া হয় । কেননা আর্টের প্রকাশকে সত্য করতে গেলেই তার মধ্যে অতিশয়তা লাগে, নিছক তথ্যে তা সয় না । তাকে যতই ঠিকঠাক ক’রে বলা যাক না, শব্দের নির্বাচনে, ভাষার ভঙ্গিতে, ছন্দের ইশারায় এমন-কিছু থাকে যেটা সেই ঠিকঠাককে ছাড়িয়ে যায়, যেটা অতিশয় । তথ্যের জগতে ব্যক্তিস্বরাপ হচ্ছে সেই অতিশয় । কেজো ব্যবহারের সঙ্গে সীেজন্যের প্রভেদ ঐখানে ; কেজো ব্যবহারে হিসেব করা কাজের তাগিদ, সৌজন্যে আছে সেই অতিশয় যা ব্যক্তিপুরুষের মহিমার ভাষা । প্ৰাচীন গ্ৰীসের প্রাচীন রোমের সভ্যতা গেছে অতীতে বিলীন হয়ে । যখন বেঁচে ছিল তাদের বিস্তর ছিল বৈষয়িকতার দায় । প্রয়োজনগুলি ছিল নিরেট নিবিড় গুরুভার ; প্রবল উদবেগ, প্রবল উদ্যম ছিল তাদের বেষ্টন করে । আজ তার কোনো চিহ্ন নেই । কেবল এমন-সব সামগ্ৰী আজও আছে যাদের ভার ছিল না, বস্তু ছিল না, দায় ছিল না, সৌজন্যের অত্যক্তি দিয়ে সমস্ত দেশ যাদের অভ্যর্থনা করেছে- যেমন করে আমরা সন্ত্ৰমবোধের পরিতৃপ্তি সাধন করি রাজচক্রবতীর নামের আদিতে পাচটা শ্ৰী যোগ করে। দেশ তাদের প্রতিষ্ঠিত করেছিল অতিশয়ের চূড়ায়, সেই নিম্নভূমির সমতলক্ষেত্রে নয় যেখানে প্রাত্যহিক ব্যবহারের ভিড় । মানুষের ব্যক্তিস্বরূপের যে-পরিচয় চিরকালের দৃষ্টিপাত সয়, পাথরের রেখায়, শব্দের ভাষায় তারই সম্বর্ধনাকে স্থায়ী রূপ ও অসীম মূল্য দিয়ে রেখে গেছে। যা কেবলমাত্র স্থানিক, সাময়িক, বর্তমান কাল তাকে যত প্রচুর মূল্যই দিক, দেশের প্রতিভার কাছ থেকে অতিশয়ের সমাদর সে স্বভাবতই পায় নি, যেমন পেয়েছে জ্যোৎস্নারাতে ভেসে-যাওয়া নীেকোর সেই সারিগান মাঝি, তোর বৈঠা নে রে, আমি আর বাইতে পারলাম না । যেমন পেয়েছে নাইটিঙ্গেল পাখির সেই গান, যে-গান শুনতে শুনতে কবি বলেছেন তার প্ৰিয়াকে Listen Eugenia. How thick the burst comes crowding through the leaves. Again- thou hearest? Eternal passion Eetenal pain পূর্বেই বলেছি, রসমাত্রেই অর্থাৎ সকলরকম হৃদয়বোধেই আমরা বিশেষভাবে আপনাকেই জানি, সেই জানাতেই বিশেষ আনন্দ । এইখানেই তর্ক উঠতে পারে, যো-জানায় দুঃখ সেই জানাতেও আনন্দ এ কথা স্বতে বিরুদ্ধ - দুঃখকে, ভয়ের বিষয়কে আমরা পরিহার্য মনে করি তার কারণ, তাতে আমাদের হানি হয়, আমাদের প্রাণে আঘাত দেয়, তা আমাদের স্বার্থের প্রতিকুলে যায়। প্রাণরক্ষার স্বার্থরক্ষার প্রবৃত্তি আমাদের অত্যন্ত প্ৰবল, সেই প্রবৃত্তি ক্ষুন্ন হলে সেটা দুঃসহ হয় । এইজন্যে দুঃখবোধ আমাদের ব্যক্তিগত আত্মবোধকে উদ্দীপ্ত করে দেওয়া সত্ত্বেও সাধারণত তা আমাদের কাছে অপ্ৰিয় । এটা দেখা গেছে, যে-মানুষের স্বভাবে ক্ষতির ভয়, প্ৰাণের ভয় যথেষ্ট প্রবল নয় বিপদকে সে ইচ্ছাপূর্বক আহবান করে, দুৰ্গমের পথে যাত্রা করে, দুঃসাধ্যের মধ্যে পড়ে ঝাপ দিয়ে । কিসের লোভে । কোনো দুর্লভ ধন অর্জন করবার জন্যে নয়, ভয়-বিপদের সংঘাতে নিজেকেই প্ৰবল আবেগে উপলব্ধি করবার জন্যে । অনেক শিশুকে নিষ্ঠুর হতে দেখা যায় ; কীটপতঙ্গ পশুকে যন্ত্রণা দিতে তারা তীব্র আনন্দ বোধ করে । শ্ৰেয়োবুদ্ধি প্রবল হলে এই আনন্দ সম্ভব হয় না ; তখন শ্ৰেয়োবুদ্ধি বাধারূপে কাজ করে । স্বভাবত রা অভ্যাসবশত এই বুদ্ধি হ্রাস হলেই দেখা যায়, হিংস্ৰতার আনন্দ অতিশয় তীব্ৰ, ইতিহাসে তার বহু প্রমাণ আছে এবং জেলখানার এক শ্রেণীর কর্মচারীর মধ্যেও তার দৃষ্টান্ত নিশ্চয়ই দুর্লভ নয় । এই হিংস্ৰতারই অহৈতুক আনন্দ নিন্দুকদের ; নিজের কোনো বিশেষ ক্ষতির উত্তেজনাতেই যে মানুষ নিন্দা করে, তা নয় । যাকে সে জানে না, যে তার কোনো অপকার করে নি, তার নামে অকারণ কলঙ্ক