পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8૦ রবীন্দ্র-রচনাবলী টেকিশালে মাসি ধান ভানে, বাঘ এসে দাড়ালো সেখানে । পাকিয়ে ভীষণ দুই গোফ বলে, "চাইগ্নিসেরিন সোপ !” ছোটাে মেয়ে চোখ দুটাে মস্ত করে ই ক'রে শোনে। আমি বলি, “আজ এই পর্যন্ত ।” সে অস্থির হয়ে বলে, “না, বলো, তার পরে ।” সে নিশ্চিত জানে, সাবানের চেয়ে, যারা সাবান মাখে বাঘের লোভ তাদেরই পরে বেশি। তবু এই সম্পূৰ্ণ আজগবি গল্প তার কাছে সম্পূর্ণ বাস্তব, প্ৰাণীবৃত্তান্তের বাঘ তার কাছে কিছুই না। ঐ আয়না-দেখা খ্যাপা বাঘকে তার সমস্ত মনপ্রাণ একান্ত অনুভব করাতেই সে খুশি হয়ে উঠছে। একেই বলি মনের লীলা, কিছুই-না নিয়ে তার সৃষ্টি, তার আনন্দ । সুন্দরকে প্ৰকাশ করাই রাসসাহিত্যের একমাত্র লক্ষ্য নয়, সে কথা পূর্বেই বলেছি। সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতায় একটা স্তর আছে, সেখানে সৌন্দৰ্য খুবই সহজ । ফুল সুন্দর, প্ৰজাপতি সুন্দর, ময়ুর সুন্দর । এ সৌন্দর্য একতলাওয়ালা, এর মধ্যে সদর-অন্দরের রহস্য নেই, এক নিমেষেই ধরা দেয়, সাধনার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু, এই প্ৰাণের কোঠায় যখন মনের দান মেশে, চরিত্রের সংস্রব ঘটে, তখন এর মহল বেড়ে যায় ; তখন সৌন্দর্যের বিচার সহজ হয় না । যেমন মানুষের মুখ ! এখানে শুধু চোখে চেয়ে সরাসরি রায় দিতে গেলে ভুল হবার আশঙ্কা । সেখানে সহজ আদর্শে যা অসুন্দর তাকেও মনোহর বলা অসম্ভব নয় । এমন-কি, সাধারণ সৌন্দর্যের চেয়েও তার আনন্দজনকতা হয়তে গভীরতর । ঠংরির টপ্পা শোনাবামাত্র মন চঞ্চল হয়ে থাকে, টােড়ির চৌতাল চৈতন্যকে গভীরতায় উদবুদ্ধ করে । “ললিতলবঙ্গলতাপরিশীলন মধুর হতে পারে, কিন্তু বসন্তাপুষ্পাভরণং বহন্তী” মনোহর । একটা কানের, আর-একটা মনের ; একটাতে চরিত্র নেই, লালিত্য আছে, আর-একটাতে চরিত্রই প্রধান । তাকে চিনে নেবার জন্যে অনুশীলনের দরকার করে । যাকে সুন্দর বলি তার কোঠা সংকীর্ণ, যাকে মনোহর বলি তা বহুদূরপ্রসারিত । মন ভোলাবার জন্যে তাকে অসামান্য হতে হয় না, সামান্য হয়েও সে বিশিষ্ট । যা আমাদের দেখা অভ্যস্ত ঠিক সেইটোকেই যদি ভাষায় আমাদের কাছে অবিকল হাজির করে দেয়, তবে তাকে বলব সংবাদ । কিন্তু, আমাদের সেই সাধারণ অভিজ্ঞতার জিনিসকেই সাহিত্য যখন বিশেষ করে আমাদের সামনে উপস্থিত করে তখন সে আসে অভূতপূর্ব হয়ে, সে হয়। সেই একমাত্র, আপনাতে আপনি স্বতন্ত্র । সন্তানস্নেহে কর্তব্যবিস্মৃত মানুষ অনেক দেখা যায়, মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্র আছেন সেই অতি সাধারণ বিশেষণ নিয়ে। কিন্তু, রােজ্যাধিকারবঞ্চিত এই অন্ধ রাজা কবিলেখনীর নানা সূক্ষ্ম স্পর্শে দেখা দিয়েছেন সম্পূর্ণ একক হয়ে । মোটা গুণটা নিয়ে তার সমজাতীয় লোক অনেক আছে, কিন্তু জগতে ধৃতরাষ্ট্র অদ্বিতীয় ; এই মানুষের একান্ততা তার বিশেষ ব্যবহারে নয়, কোনো আংশিক পরিচয়ে নয়, সমগ্রভাবে । কবির সৃষ্টিমন্ত্রে প্রকাশিত এই তার অনন্যসদৃশ স্বকীয় রূপ প্রতিভার কোন সহজ নৈপুণ্যে সম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে, ক্ষুদ্র সমালোচকের বিশ্লেষণী লেখনী তার অন্ত পাবে না । সংসারে অধিকাংশ পদার্থ প্রত্যক্ষত আমাদের কাছে সাধারণ শ্রেণীভুক্ত । রাস্তা দিয়ে হাজার লোক চলে ; তারা যদিচ প্রত্যেকেই বিশেষ লোক তবু আমার কাছে তারা সাধারণ মানুষমাত্র, এক বৃহৎ সাধারণতার আস্তরণে তারা আবৃত, তারা অস্পষ্ট । আমার আপনার কাছে আমি সুনিশ্চিত, আমি কুশৰ অন্য কেউ যখন তার বিশিষ্টতা নিয়ে আসে তখন তাকে আমারই সমপর্যায়ে ফেলি, আনন্দিত একটা কথা স্পষ্ট করা দরকার। আমার ধোবা আমার কাছে নিশ্চিত সত্য সন্দেহ নেই, এবং তার অনুবতী যে-বাহন সেও । ধোবা বলেই প্রয়োজনের যোগে সে আমার খুব কাছে, কিন্তু আমার ব্যক্তিপুরুষের সম্যক অনুভূতির বাইরে। পূর্বে অন্যত্র এক জায়গায় বলেছি যে, যে-কোনো পদার্থের সঙ্গে আমাদের ব্যবহারের সম্বন্ধই প্রধান সে-পদাৰ্থ সাধারণ শ্রেণীভুক্ত হয়ে যায়, তার বিশিষ্টতা আমাদের কাছে অগোচর হয়ে পড়ে। কবিতায়