পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে 8yس\C( থাকতে পারি নে। মূক পশুপাখিরও আছে অপরিণত ভাষা ; তাতে কিছু আছে ধ্বনি, কিছু আছে ভঙ্গি ; এই ভাষায় তারা পরস্পরের কাছে কিছু খবরও জানায়, কিছু ভাবও জানায়। মানুষের ভাষা তার এই প্রয়োগসীমা অনেক দূরে ছাড়িয়ে গেছে। সন্ধান ও যুক্তির জোরে তথ্যগত সংবাদ পরিণত হয়েছে বিজ্ঞানে 1 হবা-মাত্র তার প্রাত্যহিক ব্যক্তিগত বন্ধন ঘুচে গেল । যে জগৎটা “আমি আছি এইমাত্ৰ ব'লে আপনাকে জানান দিয়েছে, মানুষ তাকে নিয়ে বিরাট জ্ঞানের জগৎ রচনা করলে । বিশ্বজগতে মানুষের যে-যোগটা ছিল ইন্দ্ৰিয়বোধের দেখাশোনায়, সেইটোকে জ্ঞানের যোগে বিশেষভাবে অধিকার ক’রে নিলে সকল দেশের সকল কালের মানুষের বুদ্ধি। ভাবপ্রকাশের দিকেও মানুষের সেই দশা ঘটল। তার খুশি, তার দুঃখ, তার রাগ, তার ভালোবাসাকে মানুষ কেবলমাত্র প্রকাশ করল তা নয়, তাকে প্রকাশের উৎকর্ষ দিতে লাগল ; তাতে সে আশু উদবেগের প্রবর্তন ছাড়িয়ে গেল, তাতে মানুষ লাগালে ছন্দ, লাগালে সুর, ব্যক্তিগত বেদনাকে দিলে বিশ্বজনীন রূপ। তার আপনি ভালোমন্দলাগার জগৎকে অন্তরঙ্গ ভাবে সকল মানুষের সাহিত্যজগৎ করে নিলে । সাহিত্য শব্দটার কোনো ধাতুগত অর্থব্যাখ্যা কোনো অলংকারশাস্ত্ৰে আছে কি না জানি না। ঐ শব্দটার যখন প্ৰথম উদ্ভাবন হয়েছিল তখন ঠিক কী বুঝে" হয়েছিল তা নিশ্চিত বলবার মতো বিদ্যা আমার নেই। কিন্তু, আমি যাকে সাহিত্য বলে থাকি তার সঙ্গে ঐ শব্দটার অর্থের মিল করে যদি দেখাই BBB LBDLD DBD DB D DBB DDD S সাহিত্যের সহজ অর্থ যা বুঝি সে হচ্ছে নৈকট্য, অর্থাৎ সম্মিলন । মানুষকে মিলতে হয় নানা প্রয়োজনে, আবার মানুষকে মিলতে হয় কেবল মেলবারই জন্যে, অর্থাৎ সাহিত্যেরই উদ্দেশে । শাকসবজির খেতের সঙ্গে মানুষের যোগ ফসল-ফলানোর যোগ । ফুলের বাগানের সঙ্গে যোগ সম্পূর্ণ পৃথক জাতের। সবজি খেতের শেষ উদ্দেশ্য খেতের বাইরে, সে হচ্ছে ভোজ্যসংগ্ৰহ। ফুলের বাগানের যে-উদ্দেশ্য তাকে এক হিসাবে সাহিত্য বলা যেতে পারে । অর্থাৎ, মন তার সঙ্গে মিলতে চায়- সেখানে গিয়ে বসি, সেখানে বেড়াই, সেখানকার সঙ্গে যোগে মন খুশি হয় । এর থেকে বুঝতে পারি, ভাষার ক্ষেত্রে সাহিত্য শব্দের তাৎপর্যকী। তার কাজ হচ্ছে হৃদয়ের যোগ ঘটানো, যেখানে যোগটাই শেষ লক্ষ্য । w ব্যাবসাদার গোলাপ-জলের কারখানা করে, শহরের হাটে বিক্রি করতে পাঠায় ফুল । সেখানে ফুলের সৌন্দর্যমহিমা গীেশ, তার বাজারদরের হিসাবটাই মুখ্য। বলা বাহুল্য, এই হিসাবটাতে আগ্ৰহ থাকতে পারে, কিন্তু রস নেই। ফুলের সঙ্গে অহৈতুক মিলনে এই হিসাবের চিন্তাটা আড়াল তুলে দেয় । গোলাপ-জলের কারখানাটা সাহিত্যের সামগ্ৰী হল না । হতেও পারে কবির হাতে, কিন্তু মালেকের হাতে নয় । সে অনেক দিনের কথা, বোটে চলেছি। পদ্মায়। শরৎকালের সন্ধ্যা ; সূর্য মেঘন্তবকের মধ্যে র্তার শেষ ঐশ্বর্ষের সর্বদ্বদান পণ করে সদ্য অন্ত গেছেন। আকাশের নীরবতা অনির্বচনীয় শান্তরসে কানায় কানায় পূর্ণ ; ভরা নদীতে কোথাও একটু চাঞ্চল্য নেই ; স্তব্ধ চিকণ জলের উপর সন্ধ্যাভ্রের নানা বর্ণের দীপ্তিচ্ছায়া স্নান হয়ে মিলিয়ে আসছে। পশ্চিম দিকের তীরে দিগন্তপ্রসারিত জনশূন্য বালুচর প্রাচীন যুগান্তরের অতিকায় সরীসৃপের মতো পড়ে আছে। বোট চলেছে। অন্য পারের প্রান্ত বেয়ে, ভাঙন-ধরা খাড়া পাড়ির তলা দিয়ে দিয়ে ; পাড়ির গায়ে শত শত গর্তে গাঙশালিকের বাসা ; হঠাৎ একটা বড়ো মাছ জলের তলা থেকে ক্ষণিক কলশব্দে লাফ দিয়ে উঠে বঙ্কিম ভঙ্গিতে তখনই তলিয়ে গেল । আমাকে চকিত আভাসে জানিয়ে দিয়ে গেল। এই জলাযবনিকার অন্তরালে নিঃশব্দ জীবলোকে নৃত্যপর প্রাণের আনন্দের কথা, আর সে যেন নমস্কার নিবেদন করে গেল বিলীয়মান দিনান্তের কাছে। সেই মুহুর্তেই তপসিামাঝি চাপা আক্ষেপের সুরে সনিশ্বাসে বলে উঠল, “ও ! মন্ত মাছটা।” মাছটা ধরা পড়েছে আর সেটা তৈরি হচ্ছে রান্নার জন্যে, এই ছবিটাই তার মনে জেগে উঠলে ; চার দিকের অন্য ছবিটা খণ্ডিত হয়ে দূরে গেল সারে । বলা যেতে পারে, বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে তার সাহিত্য গেল নষ্ট হয়ে ।