পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8bም8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী আহারে তার আসক্তি তাকে আপনি জঠরগহবরের কেন্দ্ৰে টেনে রাখল। আপনাকে না ভুললে মিলন झझ •ा । মানুষের নানা চাওয়া আছে, সেই চাওয়ার মধ্যে একটি হচ্ছে খাবার জন্যে এই মাছকে চাওয়া । কিন্তু, তার চেয়ে তার বড়ো চাওয়া, বিশ্বের সঙ্গে সাহিত্য অর্থাৎ সন্মিলন চাওয়া- নদীতীরে সেই সূর্যস্ত-আলোকে-মহিমান্বিত দিনাবসানকে সমান্ত মনের সঙ্গে মিলিত করতে চাওয়া । এই চাওয়া আপনার অবরোধের মধ্য থেকে আপনাকে বাইরে আনতে চাওয়া । বিক দাড়িয়ে আছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বনের প্রান্তে সরোবরের তটে, সূৰ্য উঠছে আকাশে, আরক্ত রশ্মির স্পর্শপাতে জল উঠছে ঝলমল করে- এই দৃশ্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্মিলিত আপনার মনটিকে ঐ বক কি চাইতে জানে। এই আশ্চর্য চাওয়ার প্রকাশ মানুষের সাহিত্যে। তাই ভর্তৃহরি বলেছেন, যে-মানুষ সাহিত্যসংগীতকলাবিহীন সে পশু, কেবল তার পুচ্ছবিষাণ নেই এইমাত্র প্রভেদ । পশুপক্ষীর চৈতন্য প্রধানত আপন জীবিকার মধ্যেই বদ্ধ- মানুষের চৈতন্য বিশ্বে মুক্তির পথ তৈরি করছে, বিশ্বে প্রসারিত করছে নিজেকে, সাহিত্য তারই একটি বড়ো পথ । আমি যে-টেবিলে বসে লিখছি তার এক ধারে এক পুস্পপাত্রে আছে। রজনীগন্ধার গুচ্ছ, আর-একটাতে আছে ঘন সবুজ পাতার ফাঁকে ফাকে সাদা গন্ধরাজ । লেখবার কাজে এর প্রয়োজন নেই। এই অপ্রয়োজনের আয়োজনে আমার একটা আত্মসম্মানের ঘোষণা আছে মাত্র । ঐটোতে আমার একটা কথা নীরবে রয়ে গেছে ; সে এই যে, জীবনযাত্রার প্রয়োজন আমার চার দিকে আপনি নীরঞ্জ প্রাচীর তুলে আমাকে আটক করে নি। আমার মুক্ত স্বরূপ আপনাকে প্রমাণ করছে। ঐ ফুলের পাত্রে । চৈতন্য যার বন্দী, বিশ্বের সঙ্গে যথার্থ সাহিত্যলাভের মাঝখানে তার বাধা আছে- তার রিপু, তার দুর্বলতা, তার কল্পনা দৃষ্টির অন্ধতা । আমি বন্দী নই, আমার দ্বার খোলা, তার প্রমাণ দেবে ঐ অনাবশ্যক ফুল ; ওর সঙ্গে যোগ বিশ্বের সঙ্গে যোগেরই একটি মুক্ত বাতায়ন । ওকে চেয়েছি সেই অহৈতুক চাওয়ায় মানুষ যাতে মুক্ত হয় একান্ত আবশ্যিকতা থেকে । এই আপনি নিষ্কাম সম্বন্ধটি স্বীকার করবার জন্যে মানুষের কত উদ্যোগ তার সংখ্যা নেই। এই কথাটাই ভালো করে প্রকাশ করবার জন্যে মুন্নবসমাজে রয়েছে কত কবি, কত শিল্পী । সদ্য-তৈরি নতুন মন্দির, চুনকাম-করা । তার চার দিকে গাছপালা । মন্দিরটা তার আপনি শ্যামল পরিবেশের সঙ্গে মিলছে না । সে আছে। উদ্ধত হয়ে, স্বতন্ত্র হয়ে । তার উপর দিয়ে কালের প্রবাহ বইতে থাক, বৎসরের পর বৎসর এগিয়ে চলুক। বর্ষার জলধারায় প্রকৃতি তার অভিষেক করুক, রৌদ্রের তাপে তার বালির বঁাধন কিছু কিছু খসতে থাক, অদৃশ্য শৈবালের বীজ লাগুক তার গায়ে এসে ; তখন ধীরে ধীরে বনপ্রকৃতির রঙ লাগবে এর সর্বাঙ্গে, চলরি দিকের সঙ্গে এর সামঞ্জস্য সম্পূৰ্ণ হতে থাকবে । বিষয়ী লোক আপনার চার দিকের সঙ্গে মেলে না, সে আপনাতে আপনি পৃথক ; এমন-কি, জ্ঞানীর লোকও মেলে না, সে স্বতন্ত্র ; মেলে ভাবুক লোক । সে আপন ভাবরসে বিশ্বের দেহে আপন রঙ লাগায়, মানুষের রঙ । স্বভাবত বিশ্বজগৎ আমাদের কাছে তার বিশুদ্ধ প্ৰাকৃতিকতায় প্রকাশ পায় । কিন্তু, মানুষ তো কেবল প্ৰাকৃতিক নয়, সে মানসিক । মানুষ তাই বিশ্বের উপর অহরহ আপন মন প্রয়োগ করতে থাকে । বস্তুবিশ্বের সঙ্গে মনের সামঞ্জস্য ঘটিয়ে তোলে। জগৎটা মানুষের ভাবানুষঙ্গে অর্থাৎ তার অ্যাসোসিয়েশনে মণ্ডিত হয়ে ওঠে। মানুষের ব্যক্তিস্বরূপের পরিণতির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বপ্রকৃতির মানবিক পরিণতির পরিবর্তন পরিবর্ধন ঘটে । আদিযুগের মানুষের কাছে বিশ্বপ্রকৃতি যা ছিল আমাদের কাছে তা নেই। প্রকৃতিকে আমাদের মানবভাবের যতই অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছি। আমাদের মনের পরিণতিও ততই বিস্তার ও বিশেষত্ব লাভ করেছে। আমাদের জাহাজ এসে লাগছে। জাপান-বন্দরে । চেয়ে দেখলুম। দেশটার দিকে- নতুন লাগল, সুন্দর লাগল। জাপানি এসে দাড়ালো ডেকের রেলিং ধরে । সে কেবল সুন্দর দেশ দেখলে না ; সে দেখলে যো-জাপানের গাছপালা নদী পর্বত যুগে যুগে মানবমনের সংস্পর্শে বিশেষ রসের রূপ নিয়েছে সেটা প্রকৃতির নয়, সেটা মানুষের । এই রসরূপটি মানুষই প্ৰকৃতিকে দিয়েছে, দিয়ে তার সঙ্গে