পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে br6. মানবজীবনের একান্ত সাহিত্য ঘটিয়েছে। মানুষের দেশ যেমন কেবলমাত্র প্রাকৃতিক নয়, তা মানবিক, সেইজন্যে দেশ তাকে বিশেষ আনন্দ দেয়- তেমনি মানুষ সমস্ত জগৎকে হৃদয়রাসের যোগে আপন মানবিকতায় আবৃত করছে, অধিকার করছে, তার সাহিত্য ঘটছে সর্বত্রই। মানুষেরা সর্বমেবাবিশন্তি । বাহিরের তথ্য বা ঘটনা যখন ভাবের সামগ্ৰী হয়ে আমাদের মনের সঙ্গে রসের প্রভাবে মিলে যায় তখন মানুষ স্বভাবতই ইচ্ছা করে, সেই মিলনকে সর্বকালের সর্বজনের অঙ্গীকারভুক্ত করতে। কেননা, রসের অনুভূতি প্রবল হলে সে ছাপিয়ে যায় আমাদের মনকে । তখন তাকে প্ৰকাশ করতে চাই নিত্যকালের ভাষায় ; কবি সেই ভাষাকে মানুষের অনুভূতির ভাষা করে তোলে ; অর্থাৎ জ্ঞানের ভাষা নয়, হৃদয়ের ভাষা, কল্পনার ভাষা । আমরা যখনই বিশ্বের যে-কোনো বস্তুকে বা ব্যাপারকে ভাবের চক্ষে দেখি তখনই সে আর যন্ত্রের দেখা থাকে না ; ফোটোগ্রাফিক লেন্সের যে যথাতথি দেখা তার থেকে তার স্বতই প্ৰভেদ ঘটে । সেই প্ৰভেদটাকে অবিকল বৰ্ণনার ভাষায় প্ৰকাশ করা যায় না । মায়ের চোখে দেখা খোকার পায়ে ছোটাে লাল জুতোকে জুতো বললে তাকে যথার্থ করে বলাই হয় না । মাকে তাই বলতে হল খোকা যাবে নায়ে, লাল জুতুয়া পায়ে । অভিধানের কোথাও এ শব্দ নেই। বৈষ্ণবপদাবলীতে যে মিশ্ৰিত ভাষা চলে গেছে সেটা যে কেবলমাত্র হিন্দিভাষার অপভ্ৰংশ তা নয়, সেটাকে পদকর্তারা ইচ্ছা করেই রক্ষা করেছেন, কেননা অনুভূতির অসাধারণত ব্যক্তি করবার পক্ষে সাধারণ ভাষা সহজ নয়। ভাবের সাহিত্য মাত্রেই এমন একটা ভাষার সৃষ্টি হয় যে-ভাষা কিছু-বা বলে, কিছু-বা গোপন করে ; কিছু যার অর্থ আছে, কিছু আছে সুর। এই ভাষাকে কিছু আড় করে, বাকা করে, এর সঙ্গে রূপক মিশিয়ে, এর অর্থকে উলট-পালট করে তবেই বস্তুবিশ্বের প্রতিঘাতে মানুষের মধ্যে যে ভাবের বিশ্ব সৃষ্টি হতে থাকে তাকে সে প্রকাশ করতে পারে । নইলে কবি বলবে কেন “দেখিবারে আঁখিপাখি ধায় ।” দেখবার আগ্রহ একটা সাধারণ ঘটনা মাত্র । সেই ঘটনাকে বাইরের জিনিস করে না রেখে তাকে মনের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হল যখন, কবি একটা অদ্ভুত কথা বললে, দেখিবারে আঁখিপাখি ধায় । আগ্রহ যে পাখির মতন ধায় এটা মনের সৃষ্ট ভাষা, বিবরণের ভাষা নয় । গোধূলিবেলার অন্ধকারে রূপসী মন্দির থেকে বাইরে এল, এ ঘটনােটা বাহ্য ঘটনা এবং অত্যন্ত সাধারণ । কবি বললেন, নববর্ষার মেঘে বিদ্যুতের রেখা যেন দ্বন্দ্ব প্রসারিত করে দিয়ে গেল । এই উপমার যোগে বাহিরের ঘটনা আপন চিহ্ন ঐকে দিয়ে গেল। আমাদের অন্তরে মন একে সৃষ্টির বিষয় করে তুলে আপন করে নিলে । কোনো এক অজ্ঞাতনামা শ্ৰীক কবির লিখিত কোনো-একটি শ্লোকের গদ্য অনুবাদ দিচ্ছি, ইংরেজি তর্জমার থেকে : আপেল গাছের ডালের ফাকে ফঁাকে ঝুরুঝুরু বইছে। শরতের হাওয়া ; থারথার করে কেঁপে-ওঠা পাতার মধ্যে থেকে ঘুম আসছে অবতীর্ণ হয়ে পৃথিবীর দিকে- ছড়িয়ে পড়ছে। নদীর ধারার মতো । এই-যে কম্পমান ডালপালার মধ্যে মর্মরমুখর স্নিগ্ধ হওয়ায় নিঃশব্দ নদীর মতো ব্যাপ্ত হয়ে পড়া ঘুমের রাত্রি, এ আমাদের মনের রাত্রি । এই রাত্রিকে আমরা আপন করে তুলে তবেই পূর্ণভাবে উপভোগ করতে পারি। - কোনো চীনদেশীয় কবি বলছেন পাহাড় একটানা উঠে গেছে বহুশত হাত উচ্চে ; সরোবর চলে গেছে শত মাইল, কোথাও তার ঢেউ নেই ; বালি ধুধু করছে নিষ্কলঙ্ক শুভ্ৰ ; শীতে গ্ৰীষ্মে সমান অক্ষুন্ন সবুজ দেওদার-বন নদীর ধারা চলেইছে, বিরাম নেই তার ;