পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8br:9 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী গাছগুলো বিশ হাজার বছর আপন পণ সমান রক্ষা করে এসেছেহঠাৎ এরা একটি পথিকের মন থেকে জুড়িয়ে দিল সব দুঃখবেদনা, একটি নতুন গান বানাবার জন্যে চালিয়ে দিল তার লেখনীকে । মানুষের দুঃখ জুড়িয়ে দিল নদী পর্বত সরোবর । সম্ভব হয় কী ক’রে । নদী পর্বতের অনেক প্রাকৃতিক গুণ আছে কিন্তু সাত্মনার মানসিক গুণ তো নেই। মানুষের আপন মন তার মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে নিজের সাত্মনা সৃষ্টি করে। যা বস্তুগত জিনিস তা মানুষের মনের স্পর্শে তারই মনের জিনিস হয়ে ওঠে । সেই মনের বিশ্বের সম্মিলনে মানুষের মনের দুঃখ জুড়িয়ে যায়, তখন সেই সাহিত্য থেকেই সাহিত্য জাগে । বিশ্বের সঙ্গে এই মিলনটি সম্পূর্ণ অনুভব করার এবং ভোগ করার ক্ষমতা সকলের সমান নয়। কারণ, যে-শক্তির দ্বারা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের মিলনটা কেবলমাত্র ইন্দ্ৰিয়ের মিলন না হয়ে মনের মিলন হয়ে ওঠে সোঁ-শক্তি হচ্ছে কল্পনাশক্তি ; এই কল্পনাশক্তিতে মিলনের পথকে আমাদের অন্তরের পথ করে তোলে, যা-কিছু আমাদের থেকে পৃথক এই কল্পনার সাহায্যেই তাদের সঙ্গে আমাদের একাত্মতার বোধ সম্ভবপর হয়, যা আমাদের মনের জিনিস নয়। তার মধ্যেও মন প্ৰবেশ করে তাকে মনোময় করে তুলতে পারে । এই লীলা মানুষের, এই লীলায় তার আনন্দ । যখন মানুষ বলে ‘কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে’। তখন বুঝতে হবে, যে-মানুষকে মন দিয়ে নিজেরই ভাবরসে আপন ক'রে তুলতে হয় তাকেই আপন করা হয় নি- সেইজন্যে 'হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে ।” মন তাকে মনের করে নিতে পারে নি ব'লেই বাইরে বাইরে ঘুরছে । মানুষের বিশ্ব মানুষের মনের বাইরে যদি থাকে সেটাই নিরানন্দের কারণ হয় । মন যখন তাকে আপন ক'রে নেয়। তখনই তার ভাষায় শুরু হয় সাহিত্য, তার লেখনী বিচলিত হয় নতুন গানের (सन् । মানুষও বিশ্বপ্রকৃতির অন্তৰ্গত । নানা অবস্থার ঘাতে প্ৰতিঘাতে বিশ্ব জুড়ে মানবলোকে হৃদয়াবেগের ঢেউখেলা চলেছে। সমগ্র করে, একান্ত করে, স্পষ্ট করে তাকে দেখার দুটি মন্ত ব্যাঘাত আছে। পর্বত বা সরোবর বিরাজ করে অক্রিয় অর্থাৎ প্যাসিভ ভাবে ; আমাদের সঙ্গে তাদের যে-ব্যবহার সেটা প্রাকৃতিক, তার মধ্যে মানসিক কিছু নেই, এইজন্যে মন তাকে সম্পূর্ণ অধিকার করে আপন ভাবে ভাবিত করতে পারে সহজেই । কিন্তু, মানবসংসারের বাস্তব ঘটনাবলীর সঙ্গে আমাদের মনের যে-সম্পর্ক ঘটে সেটা সক্রিয় । দুঃশাসনের হাতে কীেরবসভায় দ্ৰৌপদীর যে-অসম্মান ঘটেছিল। তদনুরূপ ঘটনা। যদি পাড়ায় ঘটে তা হলে তাকে আমরা মানবভাগ্যের বিরাট শোকাবহ লীলার অঙ্গরাপে বড়ো ক’রে দেখতে পারি নে। নিত্যঘটনাবলীর ক্ষুদ্র সীমায় বিচ্ছিন্ন একটা অন্যায় ব্যাপার বলেই তাকে জানি, সে একটা পুলিস-কেস রূপেই আমাদের চোখে পড়ে- ঘূণার সঙ্গে ধিককারের সঙ্গে প্রাত্যহিক সংবাদ-আবর্জনার মধ্যে তাকে বেঁটিয়ে ফেলি। মহাভারতের খাণ্ডববন-দহ বাস্তবতার একান্ত নৈকট্য থেকে বহু দূরে গেছে- সেই দূরত্ববশত সে অকর্তৃক হয়ে উঠেছে। মন তাকে তেমনি ক’রেই সম্ভোগসৃষ্টিতে দেখতে পারে। যেমন করে সে দেখে পর্বতকে সরোবরকে । কিন্তু, যদি খবর পাই, অগ্নিগিরিস্রাবে শত শত লোকালয় শস্যক্ষেত্র পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, দগ্ধ হচ্ছে শত শত মানুষ পশুপক্ষী, তবে সেটা আমাদের করুণা অধিকার করে চিত্তকে পীড়িত করে । ঘটনা যখন বাস্তবের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে কল্পনার বৃহৎ পরিপ্রেক্ষিতে উত্তীর্ণ হয় তখনই আমাদের মনের কাছে তার সাহিত্য হয় বিশুদ্ধ ও বাধাহীন । LLLS S SqqqS মানবঘটনাকে সুস্পষ্ট ক’রে দেখবার আর-একটি ব্যাঘাত আছে । সংসারে অধিকাংশ স্থলেই ঘটনাগুলি সুসংলগ্ন হয় না, তার সমগ্ৰতা দেখতে পাই নে। আমাদের কল্পনার দৃষ্টি ঐক্যকে সন্ধান