পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে 8brፃ করে এবং ঐক্যস্থাপন করে । পাড়ায় কোনো দুঃশাসনের দৌরাত্ম্য হয়তো জেনেছি বা খবরের কাগজে পড়েছি। কিন্তু, এই ঘটনাটি তার পূর্ববতী পরবতী দূর-শাখা-প্ৰশাখাবতী একটা প্ৰকাণ্ড ট্রাজেডিকে অধিকার করে হয়তো রয়েছে- আমাদের সামনে সেই ভূমিকাটি নেই- এই ঘটনাটি হয়তো সমস্ত বংশের মধ্যে পিতামাতার চরিত্রের ভিতর দিয়ে অতীতের মধ্যেও প্রসারিত, কিন্তু সে আমাদের কাছে অগোচর। আমরা তাকে দেখি টুকরো টুকরো করে, মাঝখানে বহু অবান্তর বিষয় ও ব্যাপারের দ্বারা সে পরিচ্ছিন্ন ; সমস্ত ঘটনাটির সম্পূর্ণতার পক্ষে তাদের কোনগুলি সার্থক, কোনগুলি নিরর্থক, তা আমরা বাছাই ক’রে নিতে পারি নে। এইজন্যে তার বৃহৎ তাৎপর্য ধরা পড়ে না । যাকে বলছি বৃহৎ তাৎপর্য তাকে যখন সমগ্র করে দেখি তখনই সাহিত্যের দেখা সম্ভব হয় । ফরাসি-রাষ্ট্রবিপ্লবের সময় প্রতিদিন যে-সকল খণ্ড খণ্ড ঘটনা ঘটিছিল সেদিন তাদের চরম অর্থ কেই-বা দেখতে পেয়েছে ; কার্লাইল তাদের বাছাই ক’রে নিয়ে আপনার কল্পনার পটে সাজিয়ে একটি সমগ্রতার ভূমিকায় যখন দেখলেন, তখন আমাদের মন এই সকল বিচ্ছিন্নকে নিরবচ্ছিন্নরূপে অধিকার করতে পেরে নিকটে পেলে । খাটি ইতিহাসের পক্ষ থেকে তার বাছাইয়ে অনেক দোষ থাকতে পারে, অনেক অত্যক্তি অনেক উনোক্তি হয়তো আছে। এর মধ্যে ; বিশুদ্ধ তথ্যবিচারের পক্ষে যে-সব দৃষ্টান্ত অত্যাবশ্যক তার হয়তো অনেক বাদ পড়ে গেছে। কিন্তু, কার্লাইলের রচনায় যে সুনিবিড় সমগ্ৰতার ছবি আঁকা হয়েছে তার উপরে আমাদের মন অব্যবহিতভাবে যুক্ত ও ব্যাপ্ত হতে বাধা পায় না ; এইজন্যে ইতিহাসের দিক থেকে যদি-বা সে অসম্পূর্ণ হয় তবু সাহিত্যের দিক থেকে সে পরিপূর্ণ। এই বর্তমানকালেই আমাদের দেশে চার দিকে খণ্ড খণ্ড ভাবে রাকি উদ্যোগের নানা প্ৰয়াস নানা ঘটনায় উৎক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে। ফৌজদারি শাসনতন্ত্রের বিশেষ বিশেষ আইনের কোঠায় তাদের বিবরণ শুনছি। সংবাদপত্রের নানাজাতীয় আশুবিলীয়মান মর্মরধবনির মধ্যে । ভারতবর্ষের এ যুগের সমগ্ৰ রাষ্ট্ররূপের মধ্যে, তাদের পূর্ণভাবে দেখবার সুযোগ হয় নি ; যখন হবে তখন তারা মানুষের সমস্ত বীৰ্য সমস্ত বেদনা, সমন্ত ব্যর্থতা বা সার্থকতা, সমন্ত ভুলক্রটি নিয়ে সংবাদপত্রের ছায়ালোক থেকে উঠবে। সাহিত্যের জ্যোতিকলোকে । তখন জিজ ম্যাজিষ্ট্রেট, আইনের বই, পুলিসের যষ্টি, সমস্ত হবে গৌণ ; তখন আজকের দিনের ছিন্নবিচ্ছিন্ন ছোটাে-বড়ো দ্বন্দ্ব-বিরোধ একটা বৃহৎ ভূমিকায় ঐক্য লাভ করে নিত্যকালের মানবমনে বিরাটমূর্তিতে প্রত্যক্ষ হবার অধিকারী হবে । মানুষের সঙ্গে মানুষের নানাবিধ সম্বন্ধ ও সংঘাত নিয়ে পৃথিবী জুড়ে আমাদের অভিজ্ঞতা বিচিত্র হয়ে চলেছে। সে একটা মানসজগৎ, বহু যুগের রচনা । তাকে আমরা নৃতত্বের দিক থেকে, মনন্তত্ত্বের দিক থেকে, ঐতিহাসিক দিক থেকে বিচার করে মানুষের সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করতে পারি। সে হল তথ্য-সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের কাজ । কিন্তু, এই অভিজ্ঞতার জগতে আমরা প্ৰকাশবৈচিত্ৰ্যবান মানুষের নৈকট্য কামনা করি। এই চাওয়াটা আমাদের মনে অত্যন্ত গভীর ও প্রবল। শিশুকাল থেকে মানুষ বলেছে, “গল্প বলে ; সেই গল্প তথ্যের প্রদর্শনী নয়, কোনো-একটা মানবপরিচয়ের সমগ্ৰ ছবি, আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতা দানা বেঁধেছে তার মধ্যে । রাপের মোহিনী শক্তি, বিপদের পথে বীরত্বের অধ্যবসায়, দুর্লাভের সন্ধানে দুঃসাধ্য উদ্যম, মন্দের সঙ্গে ভালোর লড়াই, ভালোবাসায় সাধনা, ঈর্ষায় তার বিয়, এ-সমস্ত হৃদয়বোধ নানা অবস্থায় নানা আকারে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে আছে ; এর কোনোটা সুখের কোনোটা দুঃখের, এদের সাজিয়ে গল্পের ছবিতে রূপ দিয়ে রূপকথায় ছেলেদের জন্যে জোগানো হচ্ছে আদিকাল থেকে । এর মধ্যে অলৌকিক জীবের কথাও আছে, কিন্তু তারা মানুষেরই প্রতীক । আছে দৈত্য-দানব, বস্তুত তারা মানুষ ; ব্যাঙ্গমা-বেঙ্গমি, তারাও তাই। এই সব গল্পে মানুষের বাস্তব জগৎ কল্পনায় রূপান্তরিত হয়ে শিশুমনের জগৎ-রূপে দেখা দেয় ; শিশু আনন্দিত হয়ে ওঠে । মানুষ যে স্বভাবত সৃষ্টিকর্তা তাই সে সব কিছুকে আপনি সৃষ্টিতে পরিণত করে তাতে বাসা বাধে ; নিছক বিধাতার সৃষ্টিতে তাকে কুলোয় না । মানুষ আপন হাতে আপনাকে, আপনি সংসারকে তৈরি করে, সেই সংসারের ছবি বানায় আপন হাতে- তাতে তাকে নিবিড় আনন্দ দেয়, কেননা সেই ছবি তার মনের নিতান্ত কাছে আসে । যে-শকুন্তলার ঘটনা মানবসংসারে ঘটতে পারে তাকেই কবি