পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

GO 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী ঠেকেছে। এই ধারাকে যথাসাধ্য উন্মুক্ত করা চাই তো । কিন্তু, প্রাচীন ভারতের ভালো ভালো সব ছবিই যদি বিদেশে চালান যায়, তা হলে আমাদের দেশে চিত্রকলার বিদ্যাকে সজীব ও সচল রাখা কঠিন হবে । আমাদের আধুনিক চিত্রে প্রাচীন চিত্রকলার অনুকরণ করতে হবে, এমন কথা বলি নে । কিন্তু, অতীতের সাধনার মধ্যে যে-একটি প্ৰাণের বেগ আছে সেই বেগাটি আমাদের চিত্তের প্রাণশক্তিকে জাগিয়ে তোলে। অতীতের সৃষ্টিপ্রবাহকে বর্তমান কালের সৃষ্টির উদ্যমের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করলে সেই উদ্যমকে সহায়হীন করা হয় । শুধু নিজেদের অতীত-কেন, অন্য দেশের বিদ্যা থেকে আমরা যা পাই তার প্রধান দান হচ্ছে এই উদ্যম | এইজন্যে য়ুরোপে, যেখানে দেশ-বিদেশের সমস্ত মানবসংসার থেকে সকলেরকম বিদ্যার সমবায় ঘটছে, সেখানে সাধনার উদ্যম এমন আশ্চৰ্যরূপে বেড়ে উঠছে । এই কথাটি মনে ক’রে আমাদের দেশের অতীতের লুপ্তপ্রায় সমস্ত কীর্তির যথাসম্ভব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা যেন করি, তাদের পুনরাবৃত্তি করবার জন্যে নয়, নিজেদের চিত্তকে সাধনার বৃহৎ ক্ষেত্রে জাগরকে রাখবার জন্যে । জ্যৈষ্ঠ Swobo সাহিত্যসম্মিলন যখন আমরা কোনো সত্যবস্তুকে পাই তাহাকে রক্ষণপালনের জন্য বাহির হইতে উপরোধ বা উপদেশের প্রয়োজন হয় না । কোলের ছেলে মানুষ করিবার জন্য মাতাকে গুরুর মন্ত্র বা স্মৃতিসংহিতার অনুশাসন গ্ৰহণ করিতে বলা অনাবশ্যক । বাঙালি একটি সত্য বস্তু পাইয়াছে, ইহা তাহার সাহিত্য । এই সাহিত্যের প্রতি গভীর মমত্ব স্বতই বাঙালির চিত্তকে অধিকার করিয়াছে । এইরূপ একটি সাধারণ প্রীতির সামগ্ৰী সমগ্ৰ জাতিকে যেরূপ স্বাভাবিক ঐক্য দেয় এমন আর কিছুই না । স্বদেশে বিদেশে আজ যেখানে বাঙালি আছে সেখানেই বাংলাসাহিতাকে উপলক্ষ করিয়া যে সম্মিলন ঘটিতেছে, তাহার মতো অকৃত্ৰিম আনন্দকর ব্যাপার। আর কী আছে । ভিক্ষা কুরিয়া যাহা আমরা পাই তাহা আমাদের আপন.নহে, উপাৰ্জন করিয়া যাহা পাই তাহাতেও আমাদের আংশিক অধিকার ; নিজের শক্তিতে যাহা আমরা সৃষ্টি করি, অর্থাৎ যাহাতে আমাদের আত্মপ্রকাশ, তাহার পরেই আমাদের পূর্ণ অধিকার । যে-দেশে আমাদের জন্ম সেই দেশে যদি সর্বত্র আমাদের আত্মা আপন বহুধা শক্তিকে নানা বিভাগে নানারূপে সৃষ্টিকার্যে প্রয়োগ করিতে পারিত, তবে দেশকে ভালোবাসিবার পরামর্শ এত উচ্চস্বরে এবং এমন নিম্ফলভাবে দিতে হইত না । দেশে আমরা আত্মপ্ৰকাশ করি না বলিয়াই দেশকে আমরা অকৃত্ৰিম আনন্দে আপন বলিয়া জানি না । বাংলাসাহিত্য আমাদের সৃষ্টি । এমন-কি, ইহা আমাদের নূতন সৃষ্টি বলিলেও হয়। অর্থাৎ, ইহা আমাদের দেশের পুরাতন সাহিত্যের অনুবৃত্তি নয় । আমাদের প্রাচীন সাহিত্যের ধারা যে-খাতে বহিত বর্তমান সাহিত্য সেই খাতে বহে না । আমাদের দেশের অধিকাংশ আচার-বিচার পুরাতনের নিজীব পুনরাবৃত্তি । বর্তমান অবস্থার সঙ্গে তাহার অসংগতির সীমা নাই। এইজন্য তাহার অধিকাংশই আমাদিগকে পদে পদে পরাভবের দিকে লইয়া যাইতেছে। কেবল আমাদের সাহিত্যই নূতন রূপ লইয়া নূতন প্ৰাণে নূতন কালের সঙ্গে আপনি যোগসাধন করিতে প্ৰবৃত্ত । এইজন্য বাঙালিকে তাহার সাহিত্যই যথার্থভাবে ভিতরের দিক হইতে মানুষ করিয়া তুলিতেছে। যেখানে তাহার সমাজের আর-সমস্তই স্বাধীন পন্থার বিরোধী, যেখানে তাহার লোকাচার তাহাকে নিবিচার অভ্যাসের দাসত্বপাশে আচল করিয়া বাধিয়াছে, সেখানে তাহার সাহিত্যই তাহার মনকে মুক্তি দিবার একমাত্র শক্তি । বাহিরে যখন সে