পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে ○ の為 কলারচনায়, পরিমাণের হিসাবটা বড়ো হিসাব নয়, সে ক্ষেত্রে অল্প হয়তো বেশির চেয়ে বেশি হতেও পারে । সাহিত্যকে ঠিক ভাবে যে দেখে সে মেপে দেখে না, তলিয়ে দেখে ; লম্বা পাড়ি দিয়ে সাতার না। কাটলেও তার চলে, সে ডুব দিয়ে পরিচয় পায়, সেই পরিচয় অন্তরতর। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বা ঐতিহাসিক তথ্যের জন্যে পরিমাণের দরকার, স্বাদের বিচারের জন্যে এক গ্রাসের মূল্য দুই গ্রাসের চেয়ে কম নয় । বস্তুত এই ক্ষেত্রে অধিক অনেক সময়ে স্বল্পের শত্রু হয়ে দাড়ায় ; অনেককে দেখতে গিয়ে যে চিত্তবিক্ষেপ ঘটে তাতে এককে দেখবার বাধা ঘটায় । রসসাহিত্যে এই এককে দেখাই আসল দেখা । একজন য়ুরোপীয় আর্টিস্টকে একদিন বলেছিলুম যে, ইচ্ছা করে ছবি আঁকার চর্চা করি, কিন্তু আমার দৃষ্টি ক্ষীণ বলে চেষ্টা করতে সাহস হয় না। তিনি বললেন, “ও ভয়টা কিছুই নয়, ছবি আঁকতে গেলে চােখে একটু কম দেখাই দরকার ; পাছে অতিরিক্ত দেখে ফেলি। এই আশঙ্কায় চােখের পাতা ইচ্ছে ক’রেই কিছু নামিয়ে দিতে হয়। ছবির কাজ হচ্ছে সার্থক দেখা দেখানো ; যারা নিরর্থক অধিক দেখে তারা বস্তু দেখে বেশি, ছবি দেখে কম ।” দেশের লোক কাছের লোক- তাদের সম্বন্ধে আমার ভয়ের কথাটা এই যে, তারা আমাকে অনেকখানি দেখে থাকেন, সমগ্রকে সার্থককে দেখা তাদের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে । আমার নানা মত আছে, নানা কর্ম আছে, সংসারে নানা লোকের সঙ্গে আমার নানা সম্বন্ধ আছে ; কাছের মানুষের কোনো দাবি আমি রক্ষা করি, কোনো দাবি আমি রক্ষা করতে অক্ষম ; কেউ-বা। আমার কাছ তাদের কাজের ভাবের চিন্তার সম্মতি বা সমর্থন পান কেউ-বা পান না, এই সমস্তকে জড়িয়ে আমার পরিচয় তাদের কাছে নানাখানা হয়ে ওঠে- নানা লোকের ব্যক্তিগত রুচি, অনভিরুচি ও রাগদ্বেষের ধূলি-নিবিড় আকাশে আমি দৃশ্যমান। যে-দূরত্ব দৃশ্যতার অনাবশ্যক আতিশয্য সরিয়ে দিয়ে দৃষ্টিবিষয়ের সত্যকে স্পষ্ট করে তোলে, দেশের লোকের চোখের সামনে সেই দূরত্ব দুর্লভ । মুক্তকালের আকাশের মধ্যে সঞ্চরণশীল যে-সত্যকে দেখা আবশ্যক, নিকটের লোক সেই সত্যকে প্রায়ই একান্ত বর্তমান কালের আলপিন দিয়ে রুদ্ধ করে ধরে ; তার পাখার পরিধির পরিমাণ দেখে, কিন্তু ওড়ার মধ্যে সেই পাখার সম্পূর্ণ ও যথার্থ পরিচয় দেখে না । এইরকম দেশের লোকের অতি নিকট দৃষ্টির কাছে নিজের যে খর্বতা তা আমি অনেককাল থেকে অনুভব করে এসেছি। দেশের লোকের সভায় এরই সংকোচ আমি এড়াতে পারি নে। অন্যত্র জগদবরেণ্য লোকদের সামনে আমাকে কথা বলতে হয়েছে, কিছুমাত্র দ্বিধা আমার মনে কোনোদিন আসে নি ; নিশ্চয় জেনেছি, তারা আমাকে স্পষ্ট ক'রে বুঝবেন, একটি নির্মল ও প্রশস্ত ভূমিকার মধ্যে আমার কথাগুলিকে তারা ধীরে দেখতে পারবেন । এ দেশে, এমন-কি, অল্পবয়স্ক ছাত্রদের সামনেও দাড়াতে আমার সংকোচ বোধ হয়- জানি যে, কত কী ঘরাও কারণে ও ঘর-গড়া অসত্যের ভিতর দিয়ে আমার সম্বন্ধে তাদের বিচারের আদর্শ উদার হওয়া সম্ভবপর হয় না । এইজন্যেই যমরাজের নিন্দার প্রতিবাদ করতে বাধ্য হয়েছি ; কারণ, তার উপরে আমার মন্ত ভরসা । তিনি নৈকট্যের অন্তরাল ঘুচিয়ে দেবেন ; আমার মধ্যে যা-কিছু অবান্তর নিরর্থক ক্ষণকালীন, আর আমার সম্বন্ধে যা-কিছু মিথ্যা সৃষ্টি, সে-সমস্তই তিনি এক অন্তিম নিশ্বাসে উড়িয়ে দেবেন। বাহিরের নৈকট্যকে সরিয়ে ফেলে অন্তরের নৈকট্যকে তিনি সুগম করবেন। কবিরাজদের পরম সুহৃদ মুদিন তিনি আমাকে ঠার দরবারে ডেকে নেবেন সেদিন তােমাদের এই রবীন্দ্র পরিষদ খুব एका কিন্তু, এ কথা বলে বিশেষ কোনো সাত্মনা নেই। মানুষ মানুষের নগদ গ্ৰীতি চায়। মৃত্যুর পরে স্মরণসভার সভাপতির গদগদ ভাষার করুণ রস যেখানে উচ্ছসিত, সেখানে তৃষার্তের পাত্র পৌঁছয় না। যে জীবলোকে এসেছি। এখানে নানা রসের উৎস আছে, সেই সুধারসে মর্তলোকেই আমরা অমৃতের স্বাদ পাই ; বুঝতে পারি, এই মাটির পৃথিবীতেও অমরাবতী আছে। মানুষের কাছে মানুষের গ্ৰীতি তারই মধ্যে একটি প্রধান অমৃতরস- মরবার পূর্বে এ যদি অঞ্জলি ভরে পান করতে পাই তা