পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

G?) o রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী হলে মৃত্যু অপ্রমাণ হয়ে যায়। অনেকদিনের কথা বলছি, তখন আমার অল্প বয়স। একদিন স্বপ্ন দেখেছিলেম, ব্ৰহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের মৃত্যুশয্যার পাশে আমি বসে আছি। তিনি বললেন, ‘রবি, তোমার হাতটা আমাকে দাও দেখি।” হাত বাড়িয়ে দিলেম, কিন্তু তার এই অনুরোধের ঠিক মানেটি বুঝতে পারলেম না। অবশেষে তিনি আমার হাত ধরে বললেন, “আমি এই যে জীবলোক থেকে বিদায় নিচ্ছি, তোমার হাতের স্পর্শে তারই শেষস্পর্শ নিয়ে যেতে চাই ।” সেই জীবলোকের সম্পর্শের জন্যে মনে আকাঙক্ষা থাকে । কেননা, চলে যেতে হবে । আমার কাছে সেই স্পর্শটি কোথায় স্পষ্ট, কোথায় নিবিড় । যেখান থেকে এই কথাটি আসছে, “তুমি আমাকে খুশি করেছ, তুমি যে জন্মেছ সেটা আমার কাছে সার্থক, তুমি আমাকে যা দিয়েছ তার মূল্য আমি মানি ।” বর্তমানের এই বাণীর মধ্যে ভাবীকালের দানও প্রচ্ছন্ন ; যে-শ্ৰীতি, যে-শ্রদ্ধা সত্য ও গভীর, সকল কালের সীমা সে অতিক্রম করে ; ক্ষণকালের মধ্যে সে চিরকালের সম্পদ দেয় । আমার বিদায়কাল অধিক দূরে নেই ; এই সময়ে জীবলোকের আনন্দস্পর্শ তোমাদের এই পরিষদে আমার জন্য তোমরা প্ৰস্তুত রেখেছ, তোমাদের যা দেয়া ভাবীকালের উপরে তার বরাত দাও নি । ভাবীকালকে অত্যন্ত বেশি করে জুড়ে বসে থাকবে, এমন আশাও নেই, আকাঙক্ষাও নেই। ভবিষ্যতের কবি ভবিষ্যতের আসন সগৌরবে গ্রহণ করবে। আমাদের কাজ তাদেরই স্থান প্রশস্ত করে দেওয়া । মেয়াদ ফুরোলে যে-গাছ মরে যায় অনেকদিন থেকে ঝরা পাতায় সে মাটি তৈরি করে ; সেই মাটিতে খাদ্য। জমে থাকে। পরবতী গাছের জন্যে । ভবিষ্যতের সাহিত্যে আমার জন্যে যদি জায়গার টানাটানিও হয় তবু এ কথা সবাইকে মানতে হবে যে, সাহিত্যের মাটির মধ্যে গোচরে অগোচরে প্রাণের বস্তু কিছু রেখে গেছি। নতুন প্ৰাণ নতুন রূপ সৃষ্টি করে, কিন্তু পুরাতনের জীবনধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হলে সে প্ৰাণশক্তি পায় না ; আমাদের বাণীর সপ্তকে প্ৰতিষ্ঠা লাভ করে তবেই ভবিষ্যতের বাণী উপরের সপ্তকে চড়তে পারে। সে সপ্তকের রাগিণী তখন নূতন হবে, কিন্তু পুরাতনকে অশ্রদ্ধা করবার স্পর্ধা যেন তার না হয়। মনে যেন থাকে, তখনকার কালের পুরাতন এখনকার কালে নূতনের গৌরবেই আবির্ভূত হয়েছিল। নবযুগ একটা কথা মাঝে মাঝে ভুলে যায়- তার বুঝতে সময় লাগে যে, নূতনত্বে আর নবীনত্বে প্ৰভেদ আছে। নূতনত্ব কালের ধর্ম, নবীনত্ব কালের অতীত। মহারাজা-বাহাদুর আকাশে যে-জয়ধ্বজা ওড়ান আজ সে নতুন, কাল সে পুরানো । কিন্তু সূর্যের রথে যে অরুণধজা ওড়ে কোটি কোটি যুগ ধরে প্রতিদিনই সে নবীন । একটি বালিকা তার স্বাক্ষরখাতায় আমার কাছ থেকে একটি বাংলা শ্লোক চেয়েছিল । আমি লিখে দিয়েছিলুম নূতন সে পলে পলে অতীতে বিলীন, যুগে যুগে বর্তমান সেই তো নবীন । তৃষ্ণা বাড়াইয়া তোলে নূতনের সুরা, নবীনের নিত্যসুধা তৃপ্তি করে পুরা। সৃষ্টিশক্তিতে যখন দৈন্য ঘটে তখনই মানুষ তাল ঠুকে নূতনত্বের আস্ফালন করে । পুরাতনের পাত্রে নবীনতার অমৃতরস পরিবেশন করবার শক্তি তাষের নেই, তারা শক্তির অপূর্বতা চড়া গলায় প্রমাণ করবার জন্যে সৃষ্টিছাড়া অদ্ভুতের সন্ধান করতে থাকে। সেদিন কোনাে একজন বাঙালি হিন্দু কবির কাব্যে দেখলুম, তিনি রক্ত শব্দের জায়গায় ব্যবহার করেছেন “খুন । পুরাতন রক্ত’ শব্দে তার কাব্যে রাঙা রঙ যদি না ধরে তা হলে বুঝব, সেটাতে তারই অকৃতিত্ব । তিনি রঙ লাগাতে পারেন না বলেই তাক লাগাতে চান। নতুন আসে অকস্মাতের খোচা দিতে, নবীন আসে চিরদিনের আনন্দ দিতে । সাহিত্যে এইরকম নতুন হয়ে ওঠবার জন্যে যাদের প্রাণপণ চেষ্টা তারাই উচ্চৈঃস্বরে নিজেদের তরুণ বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু, আমি তরুণ বলব তাদেরই র্যাদের কল্পনার আকাশ চিরপুরাতন রক্তরাগে অরুণবর্ণে সহজে নবীন, চরণ রাঙাবার জন্যে যাদের উষাকে নিয়ুমার্কেটে ‘খুন ফরমাশ করতে হয় না। আমি সেই তরুণদের বন্ধু, তাদের বয়স যতই প্রাচীন হােক। আর যে-বুদ্ধদের