পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে GłXS, মরচে-ধরা চিত্তবীণায় পুরাতনের স্পর্শে নবীন রাগিণী বেজে ওঠে না তাদের সঙ্গে আমার মিল হবে না, তাদের বয়স নিতান্ত কঁচা হলেও । এই পরিষদ সকল বয়সের সেই তরুণদের পরিষদ হােক । পুরাতনের নবীনতা বুঝতে তাদের যেন কোনো বাধা না থাকে । ফায়ুন ১৩৩৪ সাহিত্যরূপ আজ এই সভা আহবান করা হয়েছে এই ইচ্ছা করে যে, নবীন প্ৰবীণ সকলে মিলে সাহিত্যতত্ত্ব আলোচনা করব ; কোনো চরম সিদ্ধান্ত পাকা করে দেওয়া যাবে তা মনে করে নয় । অনেক সময়ে আমরা ঝগড়া করি পরস্পরের কথা স্পষ্ট বুঝি না বলে । শুধু তাই নয়, প্রতিপক্ষের মনে ব্যক্তিগত বিরুদ্ধতা আমরা অনেক সময়ে কল্পনা করে নিই ; তাতে করে মতান্তরের সঙ্গে মনান্তর মিশে যায়, তখন কোনোপ্রকার। আপস হওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে । মোকাবিলায় যখন আলোচনায় প্রবৃত্ত হব তখন আশা করি এ কথা বুঝতে কারও বিলম্ব হবে না যে, যে-জিনিসটা নিয়ে তর্ক করছি, সেটা আমাদের দুই পক্ষেরই দরদের জিনিস, সেটা বাংলাসাহিত্য । এই মূল জায়গায় আমাদের মিল আছে ; এখন অমিলটা কোথায় সেটা শান্তভাবে স্থির করে দেখা দরকার । আমার বয়স একদা অল্প ছিল, তখন সেকালের অল্পবয়সীদের সঙ্গে একাসনে বসে আলাপ করা সহজ ছিল । দীর্ঘকাল সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। তার কারণ এ নয় যে, আমার পক্ষে কোনো বাধা আছে। এখনকার কালে র্যারা চিন্তা করছেন, রচনা করছেন, বাংলাসাহিত্যে নেতৃত্ব নেবার ধারা উপযুক্ত হয়েছেন বা হবেন, তারা কী মনের ভাব নিয়ে আসরে নেমেছেন সে সম্বন্ধে আমার সঙ্গে সহজভাবে আলাপ-আলোচনা করবার পক্ষে তাদের মনের মধ্যে হয়তো কোনো অন্তরায় আছে । এ নিয়ে অনেকে আমাকেই অপরাধী করেন । র্তারা বলেন, আমি না জেনে অনেক সময় অনেক কথা বলে থাকি । এটা অসম্ভব নয় । আজকের দিনে বাংলাভাষায় প্রতিদিন যে-সব লেখা প্ৰকাশিত হচ্ছে তা সমস্ত পড়া আমার পক্ষে সম্ভবপর হয় নি । সে শক্তিও নেই, অবকাশেরও অভাব আছে। সেই কারণেই আজকের মতো এইরকম উপলক্ষে নুতন লেখকদের কাছ থেকে রচনা -নীতি ও রীতি সম্বন্ধে তাদের অন্তরের কথা কিছু শুনে নেব, এই ইচ্ছা করি । আলোচনাটাকে এগিয়ে দেবার জন্য প্রসঙ্গটার একটা গোড়াপত্তন করে দেওয়া ভালো । এখানে যারা উপস্থিত আছেন তাদের অনেকের চেয়ে আমার বয়স বেশি। আধুনিক বঙ্গসাহিত্য যে-যুগে আরম্ভ হয়েছিল সে আমার জন্মের অদূরবতী পূর্বকালে । সেইজন্য এই সাহিত্যসূত্রপাতের চিত্রটি আমার কাছে সুস্পষ্ট । আধুনিক বাংলা কাব্যসাহিত্য শুরু হয়েছে মধুসূদন দত্ত থেকে । তিনিই প্ৰথমে ভাঙনের এবং সেই ভাঙনের ভূমিকার উপরে গড়নের কাজে লেগেছিলেন খুব সাহসের সঙ্গে। ক্রমে ক্রমে নয়, ধীরে ধীরে নয়। পূর্বকার ধারাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে তিনি এক মুহুর্তেই নূতন পন্থা নিয়েছিলেন । এ যেন এক ভূমিকম্পে একটা ডাঙা উঠে পড়ল জলের ভিতর থেকে । আমরা দেখলুম কী । কোনো একটা নূতন বিষয় ? তা নয়, একটা নূতন রূপ। সাহিত্যে যখন কোনো জ্যোতিষ্ক দেখা দেন তখন তিনি নিজের রচনার একটি বিশেষ রূপ নিয়ে আসেন । তিনি যে-ভাবকে অবলম্বন করে লেখেন তারও বিশেষত্ব থাকতে পারে, কিন্তু সেও গৌণ ; সেই ভাবটি যে বিশেষরূপ অবলম্বন করে প্রকাশ পায় সেটিতেই তার কৌলীন্য । বিষয়ে কোনো অপূর্বতা না থাকতে পারে, সাহিত্যে হাজার বার যার পুনরাবৃত্তি হয়েছে এমন বিষয় হলেও কোনো দোষ নেই, কিন্তু সেই বিষয়টি যে-একটি বিশেষ রূপ গ্ৰহণ করে তাতেই তার অপূর্বতা । পানিপাত্র তৈরির বেলায় পাথরের