পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Gł R রবীন্দ্র-রচনাবলী যুগে পাথর ও সোনার যুগে সোনাটা উপাদােনরূপে নেওয়া হয়েছে, পণ্যের দিক থেকে বিচার করলে তার দামের ইতারবিশেষ থাকতে পারে, কিন্তু শিল্পের দিক থেকে বিচার করবার বেলায় আমরা তার রূপটাই দেখি । রসসাহিত্যে বিষয়টা উপাদান, তার রূপটাই চরম । সেইটেই আমাদের ভাষায় এবং সাহিত্যে নূতন শক্তি সঞ্চার করে, সাধনার নূতন পথ খুলে দেয় । বলা বাহুল্য, মধুসূদন দত্তের প্রতিভা আত্মপ্রকাশের জন্যে সাহিত্যে একটি রূপের প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেছিল । যাতে সেই লক্ষ্যের দিকে আপন কলমকে নিয়ে যেতে পারেন এমন একটা ছন্দের প্রশস্ত রাজপথ মাইকেল তৈরি করে তুললেন । রূপটিকে মনের মতো গাভীর্য দেবেন বলে ধ্বনিবান শব্দ বেছে বেছে জড়ো করলেন । র্তার বর্ণনীয় বিষয় যে-রূপের সম্পদ পেল সেইটোতেই সে ধন্য হল । মিলটন ইংরেজিভাষায় লাটিন-ধাতুমূলক শব্দ বহু পরিমাণে ব্যবহার করার দ্বারায় তার ধ্বনিরূপের যে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিলেন, মাইকেলেরও তদনুরূপ আকাঙক্ষা ছিল । যদি বিষয়ের গভীৰ্যই যথেষ্ট হত তা হলে তার কোনো প্রয়োজন ছিল না । এ কথা সত্য, বাংলাসাহিত্যে মেঘনাদবধ কাব্য তার দোহার পেল না । সম্পূর্ণ একলা রয়ে গেল । অর্থাৎ মাইকেল বাংলাভাষায় এমন একটি পথ খুলেছিলেন যে পথে কেবলমাত্র তারই একটিমাত্র মহাকাব্যের রথ চলেছিল । তিনি বাংলাভাষার স্বভাবকে মেনে চলেন নি । তাই তিনি যে-ফল ফলালেন তাতে বীজ ধরল না, তার লেখা সন্ততিহীন হল, উপযুক্ত বংশাবলী সৃষ্টি করল না। তার পরে হেম বািড়য্যে বৃত্ৰসংহার, নবীন সেন রৈবতক লিখলেন ; এ দুটিও মহাকাব্য, কিন্তু তাদের কাব্যের রূপ হল স্বতন্ত্র । তাদের মহাকাব্যও রূপের বিশিষ্টতার দ্বারা উপযুক্তভাবে মূর্তিমান হয়েছে কি না, এবং তাদের এই রূপের ছাদ ভাষায় চিরকালের মতো রয়ে গেল কি না, সে তর্ক এখানে করতে চাই নেকিন্তু রূপের সম্পূর্ণতা-বিচারেই তাদেরও কাব্যের বিচার চলবে ; তারা চিন্তাক্ষেত্রে অর্থনীতি ধর্মনীতি বা রাষ্ট্রনীতি সম্বন্ধে কোন কোঠা খুলে দিয়েছেন সেটা কাব্যসাহিত্যের মুখ্য বিচাৰ্য নয়। বিষয়ের গৌরব বিজ্ঞানে দর্শনে, কিন্তু রূপের গৌরব রসসাহিত্যে । মাইকেল তার নবসৃষ্টির রূপটিকে সাহিত্যে চিরপ্রতিষ্ঠা দেন নি বটে, কিন্তু তিনি সাহস দিয়ে গেলেন, নতুন লেখকদের উৎসাহ দিলেন । তিনি বললেন, প্রতিভা আপনসুষ্ট নব নব রূপের পথে সাহিত্যকে নব নব ধারায় প্রবাহিত করে দেয় । বঙ্কিমচন্দ্রের দিকে তাকালে দেখি সেই একই কথা । তিনি গল্পসাহিত্যের এক নতুন রূপ নিয়ে দেখা দিলেন। বিজয়বসন্ত বা গোলেবকাওলির যে চেহারা ছিল সে চেহারা আর রইল না। তার পূর্বেকার গল্পসাহিত্যের ছিল মুখোশ-পরা রূপ, তিনি সেই মুখোশ ঘুচিয়ে দিয়ে গল্পের একটি সজীব মুখশ্ৰীর অবতারণা করলেন । হােমার, বৰ্জিল, মিলটন প্রভৃতি পাশ্চাত্য কবিদের কাছ থেকে মাইকেল তার সাধনার পথে উৎসাহ পেয়েছিলেন ; বঙ্কিমচন্দ্ৰও কথাসাহিত্যের রূপের আদর্শ পাশ্চাত্য লেখকদের কাছ থেকে নিয়েছেন । কিন্তু এরা অনুকরণ করেছিলেন বললে জিনিসটাকে সংকীর্ণ করে বলা হয় । সাহিত্যের কোনো-একটি প্ৰাণবান রূপে মুগ্ধ হয়ে সেই রূপটিকে তারা গ্ৰহণ করেছিলেন ; সেই রূপটিকে নিজের ভাষায় প্রতিষ্ঠিত করবার সাধনায় তারা সৃষ্টিকর্তার আনন্দ পেয়েছিলেন, সেই আনন্দে তারা বন্ধন ছিন্ন করেছেন, বাধা অতিক্রম করেছেন। এক দিক থেকে এটা অনুকরণ, আর-এক দিক থেকে এটা আত্মীকরণ । অনুকরণ করবার অধিকার আছে। কার । যার আছে সৃষ্টি করবার শক্তি । আদান-প্রদানের বাণিজ্য চিরদিনই আর্টের জগতে চলেছে। মূলধন নিজের না হতে পারে, ব্যাঙ্কের থেকে টাকা নিয়ে ব্যবসা নাহয় শুরু হল, তা নিয়ে যতক্ষণ কেউ মুনাফা দেখাতে পারে। ততক্ষণ সে মূলধন তার আপনারই। যদি ফেল করে তবেই প্ৰকাশ পায় ধনটা তার নিজের নয় । আমরা জানি, এশিয়াতে এমন এক যুগ ছিল যখন পারস্যে চীনে গ্ৰীসে রোমে ভারতে আর্টের আদর্শ চালাচালি হয়েছিল। এই ঋণ-প্রতিঋণের আবর্তন-আলোড়নে সমস্ত এশিয়া জুড়ে নবনবোন্মেষশালী একটি আর্টের যুগ এসেছিল— তাতে আটিস্টের মন জাগরকে হয়েছিল, অভিভূত হয় নি। অর্থাৎ, সেদিন চীন পারস্য ভারত কে কার কাছ থেকে কী পরিমাণে ঋণ গ্ৰহণ করেছে সে কথাটা চাপা পড়েছে,