পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(SV) झोश्य़-बष्नांबळेी ভাবীকালের সমস্ত আদর্শ ধ্রুব রূপ পায়, এমনতরো মনে করা চলে না। সকল দেশের সাহিত্যেই জীবনধর্ম আছে, এইজন্যে মাঝে মাঝে সে সাহিত্যে অবসাদ ক্লান্তি রোগ মূৰ্ছা আক্ষেপ দেখা দেয়তার মধ্যে যদি প্ৰাণের জোর থাকে। তবে এ-সমস্তই সে আবার কাটিয়ে যায়। কিন্তু দূরে থেকে আমরা তার রোগকেও স্বাস্থ্যের দরে স্বীকার করে নিই। মনে করি, তার প্রকৃতিস্থ অবস্থার চেয়েও এই লক্ষণগুলো বলবান ও স্থায়ী, যেহেতু এটা আধুনিক । সাহিত্যের মধ্যে অপ্রকৃতিস্থতার লক্ষণ তখনই প্ৰকাশ পায় যখনই দেখি বিষয়টা অত্যন্ত বেশি প্রবল হয়ে উঠেছে। আজকালকার দিনে য়ুরোপে নানা কারণে তার ধর্ম সমাজ লোকব্যবহার স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধ অত্যন্ত বেশি নাড়া খাওয়াতে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সেই সমস্ত সমস্যার মীমাংসা না হলে তার বাচাও নেই। এই একান্ত উৎকণ্ঠার দিনে এই সমস্যার দল বাছবিচার করতে পারছে না । যুদ্ধের সময় সৈনিকেরা যেমন প্রয়োজনের দায়ে গৃহস্থের ঘর ও ভাণ্ডার দখল করে বসে, তেমনি প্রব্লেমের রেজিমেন্ট তাদের নিজের বারিক ছাপিয়েও সাহিত্যের সর্বত্রই ঢুকে পড়ছে। লোকে আপত্তি করছে না, কেননা সমস্যাসমাধানের দায় তাদের অত্যন্ত বেশি। এই উৎপাতে সাহিত্যের বাসা যদি প্রব্রেমের বারিক হয়ে ওঠে। তবে এ প্রশ্ন মারা যায় যে, স্থাপত্যকলার আদর্শে এই ঘরের রূপটি কী। প্রয়োজনের গরজ যেখানে অত্যন্ত বেশি সেখানে রূপ জিনিসটা অবান্তর। যুরোপে সাহিত্যের সব ঘরই প্রব্রেমের ভাণ্ডারঘর হয়ে উঠতে চেষ্টা করছে ; তাই প্রতিদিনই দেখছি, সাহিত্যে রূপের মূল্যাটা গৌণ হয়ে আসছে। কিন্তু, এটা একটা ক্ষণকালীন অবস্থা— আশা করা যেতে পারে যে, বিষয়ের দল বর্তমানের গরজে দাবি ক্ৰমে ত্যাগ করবে এবং সাহিত্যে রাপের স্বরাজ আবার ফিরে আসবে । মার্শাল লৈ যেখানে কোনো কারণে চিরকালের হয়ে ওঠে। সেখান থেকে গৃহস্থকে দেশান্তরে যাবার ব্যবস্থা করাই কর্তব্য। বিষয়প্রধান সাহিত্যই যদি এই যুগের সাহিত্য হয় তা হলে বলতেই হবে, এটা সাহিত্যের পক্ষে যুগান্ত । সভায় আমার বক্তব্য শেষ হলে পর অধ্যাপক অপূর্বকুমার চন্দ বললেন : কাব্যসাহিত্যের বিশিষ্টতা ভাবের প্রগাঢ়তায় (intensity) । কবি টমসন, ঋতুবর্ণনাচ্ছিলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি অনুরাগ প্ৰকাশ করেছেন, এইখানে ওয়ার্ডস্বার্থের সঙ্গে তার কাব্যবিষয়ের মিল আছে, কিন্তু পরস্পরের প্রভেদের མ་གྲྭ་པའི་ যে, টমসনের কবিতায় কাব্যের বিষয়টির গভীরতা নেই, বেগ নেই, ওয়ার্ডস্বার্থের আছে । আমি বললুম ; তুমি যাকে প্রগাঢ়তা বলছি সেটা বস্তুত রূপসৃষ্টিরই অঙ্গ। সুন্দর দেহের রূপের কথা যখন বলি তখন বুঝতে হবে, সেই রূপের মধ্যে অনেকগুলি গুণের মিলন আছে। দেহটি শিথিল নয়, বেশ আঁটিস্যুট, তা প্ৰাণের তেজে ও বেগে পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যসম্পদে তা সারবান, ইত্যাদি । অর্থাৎ, এই রকমের যতগুলি গুণ তার বেশি, তার রূপের মূল্যও তত বেশি । এই সব গুণগুলি একটি রূপের মধ্যে মূর্তিমান হয়ে যখন অবিচ্ছিন্ন ঐক্য পায় তখন তাতে আমরা আনন্দ পেয়ে থাকি । নাইটিঙ্গেল পাখিকে উদ্দেশ করে কীটস একটি কবিতা লিখেছেন । তার মাঝখানটায় মানবজীবনের দুঃখতাপ ও নশ্বরতা নিয়ে বিশেষ একটি বেদনা প্ৰকাশ করা হয়েছে। কিন্তু, সেই বেদনার তীব্ৰতাই কবিতার চরম কথা নয় ; মানবজীবন যে দুঃখময়, এই কথাটার সাক্ষ্য নেবার জন্যে কবির দ্বারে যাবার কোনো প্রয়োজন নেই- তা ছাড়া, কথাটা একটা সর্বাঙ্গীণ ও গভীর সত্যও নয়- কিন্তু এই নৈরাশ্যবেদনাকে উপলক্ষমাত্র করে ঐ কবিতাটি যে একটি রূপ ধরে সম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে সেইটেই হচ্ছে ওর কাব্য-হিসাবে সার্থকতা। কবি পৃথিবী সম্বন্ধে বলছেন Here, where men sit and hear each other groan ; Where palsy shakes a few, sad, last gray hairs ; Where youth grows pale, and spectre-thin, and dies ; Where but to think is to be full of sorrow And leaden-eyed despairs ;