পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে (SI) যে-সব বেদনা, যে-সব আকাঙক্ষণ থাকে এবং আমরা যাকে অন্তরে অন্তরে খুব আদর করি, সেই আদরের যোগ্য ভাষা পাই না বলে বাইরে প্রকাশ করতে পারি না, পূজা করতে পারি না, অর্ঘ্য দিতে পারি না । আমাদের সে-সম্পদ নেই, আমরা মন্দির রচনা করতে জানি না, যারা রচনা করেন ও র্যারা দেবতার প্রতিষ্ঠা করেন আমরা তাদের কাছ থেকে সুযোগ গ্রহণ করে আমাদের পূজা সেখানে দিই। বড়ো বড়ো জাতি সাহিত্যে বড়ো বড়ো পূজার জন্যে আমাদের অবকাশ রচনা করে দিয়েছেন । সমস্ত মানুষ সেখানে তঁদের অর্ঘ্য নিয়ে যাবার সুযোগ লাভ করে তঁদের কাছে কৃতজ্ঞ হয়েছে । সমাজের প্রভাতকালে প্ৰকাণ্ড একটা বীরত্বদীপ্ত প্ৰাণসম্পদ পূর্ণ মনুষ্যত্বের আনন্দময় চিত্ৰ মনের মধ্যে জাগিয়ে রেখে কবিরা রচনা করতে বেরিয়েছেন । অনেক সময় সমাজের পাথেয় নিঃশেষিত হয়ে যায় এবং বাইরের নানাপ্রকার ঘাত-প্ৰতিঘাতে ক্ৰমে ক্রমে পতন ঘটে । এইজন্য যেটা মানুষের সভ্যতার অতি-পরিণতি তাতে বিকৃতি আসে, এরূপ পরিচয় আমরা প্রাচীন গ্ৰীম রোম ও অন্যান্য দেশের ইতিহাসে বারংবার পেয়েছি। অবসাদের সময়ে কলুষটাই প্রবল হয়ে ওঠে । আমাদের দেহপ্রকৃতিতে অনেক রোগের বীজ আছে । শরীরের সবল অবস্থায় সেগুলি পরাহত হয়েই থাকে । এমন নয় যে তারা নেই । তাদের পরাভূত করে আরোগাশক্তি অব্যাহত থাকে ৷ যে-মুহুর্তে শরীর ক্লান্ত হয়, জীর্ণ হয়, দুর্বল হয়, তখনই সেগুলি প্রবল হয়ে দেখু দেয়। ইতিহাসেও বারংবার এটা দেখেছি। যখন কোনো-একটা প্ৰবৃত্তি বা মনের ভাব প্রবল হয় তখন তার প্রবলতাকে চিরন্তন সত্য বলে বিশ্বাস না করে থাকতে পারি না, তাকে একান্তভাবে অনুভব করি বলেই । সেই অনুভূতির জোরে প্রবৃত্তিকে নিয়ে আমরা বড়াই করতে শুরু করি । এইজন্য এক-একটা সময় আসে যখন এক-একটা জাতির মধ্যে মানুষের ভিতরকার বিকৃতিগুলিই উগ্র হয়ে দেখা দেয় । ইংরেজিসাহিত্যের ভিতর যখন অত্যন্ত একটা কলুষ এসেছিল সে উদ্ধত হয়েই নির্লজ্জ হয়েই আপনাকে প্রকাশ করেছিল। তার পর আবার সেটা কেটে গেছে । ফরাসীবিপ্লবের সময় ইংরেজ কবিদের মধ্যে অনেকে বিদ্রোহের কথা বলেছেন ; প্রচলিত সমাজনীতি, প্রচলিত ধর্মনীিতিকে গুরুতর আঘাত করেছেন । মানুষের মনকে কর্মকে মোহমুক্ত করে পূর্ণতা দান করবার জন্যে তঁাদের কাব্যে সাহিত্যে খুব একটা আগ্রহ দেখা গেছে। তখনকার সমাজে তাদের কাব্য নিন্দিত হয়েছে, কিন্তু কালের হাতে তার সমাদর বেড়ে গেল । এ দিকে বিশেষ কোনো যুগে যে-সব লালসার কাব্যকীর্তন প্রকাশিত হয়েছিল তারা সেকালের বিদগ্ধদের কাছে সম্মান পেয়েছে ; মনে হয়তো হয়েছিল, এইটেই সাহিত্যের চরম উৎকর্ষ । তবু পরে প্রকাশ পেয়েছে, এ জিনিসটা সেই যুগের ক্ষণকালীন উপসৰ্গ । আমাদের সংস্কৃতিসাহিত্যেও এই বিকৃতি অনেক দেখা গিয়েছে। যখন সংস্কৃতসাহিত্যে সাধনার দৈন্য এসেছিল তখন কাব্যে তার পরিচয় ফুটে উঠেছে। বর্তমান কালের আরম্ভে কবির লড়াই, পাচলি, তর্জা প্রভৃতিতে সাহিত্যের যে-বিকার দেখা দিয়েছিল সেগুলিতে বীর্যবান জাতির প্রবল উন্নতির বা মহৎ আকাঙক্ষার পরিচয় নেই। তার ভিতর অত্যন্ত পঙ্কিলতা আছে । সমাজের পথযাত্রার পাথেয় হচ্ছে উৎকর্ষের জন্যে আকাঙক্ষা । জীবনের মধ্যে ব্যবহারে তার প্রকাশ খণ্ডিত হয়ে যায় বলেই মনে তার জন্যে যে-আকাঙক্ষা আছে তাকে রত্নের মতো সাহিত্যের বহুমূল্য কীেটাের মধ্যে রেখে দিইতাকে সংসারযাত্রায় ব্যক্ত সত্যের চেয়ে সম্পূর্ণতর করে উপলব্ধি করি । এই আকাঙক্ষা যতক্ষণ মহৎ থাকে এবং এই আকাঙক্ষার প্রকাশ যতক্ষণ লোকের কাছে মূল্য পায়, ততক্ষণ সে জাতির মধ্যে যতই দোষ থােক, তার বিনাশ নেই। য়ুরোপীয় জাতির ভিতর যে-অস্বাস্থ্য রয়েছে তার প্রতিকারও তাদের মধ্যে আছে। যেখানে স্বাস্থ্যের প্রবলতা সেখানে রোগও আপাতত প্ৰবল হয়ে দেখা দেয় । কিন্তু, তৎসত্ত্বেও মানুষ বঁাচে । দুর্বল শরীরে তার প্রকাশ হলে সে মরে । আমরা এখন একটা নবযুগের আরম্ভকালে আছি। এখন নূতন কালের উপযোগী বল সংগ্ৰহ করতে হবে, যুদ্ধ করতে হবে প্রতিকূলতার সঙ্গে । আমাদের সমস্ত চিত্তকে ও শক্তিকে জাগরকে করে আমরা যদি দাড়াতে পারি তা হলেই আমরা বঁচিব । নইলে পদে পদে আমাদের পরাভব । আমাদের মজার ভিতর জীৰ্ণতা ; এইজন্য অত্যন্ত প্রয়োজন হয়েছে আমাদের যেটা তপস্যার দান সেটাকে যেন আমরা