পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে ○之> চিরকালের সাহিত্যে স্থান না পাবার যোগ্য হতেও পারে । এতকাল যা হয়েছে এখন থেকে ভবিষ্যত পর্যন্ত তার সম্পূর্ণ উলটা রকমের ব্যাপার হবে, এরকমই যদি আপনাদের মত হয় বলুন। সেদিন আপনাদের কেউ কেউ বললেন, আমার সঙ্গে তাদের মতের পার্থক্য নেই, সেটাও স্পষ্ট করে বলা দরকার । সুনীতি চট্টোপাধ্যায় : সামাজিক প্রাণী হিসাবে সাহিত্যিকের সামাজিক বিধিব্যবস্থাকে ভাঙবার কতটা অধিকার আছে আপনি বিচার করবেন । রবীন্দ্রনাথ : সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন হয় কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে । যেমন এক সময় আমাদের দেশে একান্নাবতী ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল, অবস্থা-পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার ভিত্তি শিথিল হয়েছে । সমাজব্যবস্থার যখন পরিবর্তন হয়, সে-পরিবর্তন যে কারণেই হােক- ধর্মৈিনতিক কারণেই যে সব সময় হয় তা নয়, অধিকাংশ স্থলে অর্থনৈতিক কারণেও হয়- তখন একটি কথা ভাববার আছে । তৎকালীন যে-সমস্ত ব্যবস্থা প্ৰবল ছিল, যার প্রয়োজন ছিল, তখন সেগুলোকে রক্ষা করবার জন্য কতকগুলো বিধিনিষেধ পাকা করে দেওয়া হয় । সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেলে প্রয়োজন চলে যায়, অথচ নিয়ম শিথিল হতে চায় না । সমাজ অন্ধভাবেই আপনি নিয়ম আঁকড়ে থাকে । সে বলে, যে-কারণেই হােক, একটাও নিয়ম আলগা হলেই সব নিয়মের জোর চলে যায় । সকল মানুষই সামাজিক প্রথা সম্বন্ধে বিচারবুদ্ধি খাটাবার অধিকার দাবি করলে সমাজ টিকতে পারে না । সমাজের পক্ষে এই কথা । সাহিত্য সমাজের এই সতর্কতাকে সম্মান করে না । সর্বকালের নীতির দিকে তাকিয়ে সাহিত্য অনেক সময় তাকে বিদ্রুপ করে তার বিরুদ্ধবাক্য বলে। অবশ্য সমাজের এমনও অনেক বিধি আছে যার আয়ু অল্প নয়। রীতির চেয়ে নীতির উপরে যার ভিত্তি । যেমন আমাদের হিন্দু-সমাজে গোহিত্যা পাপ বলে গণ্য, অথচ সেই উপলক্ষে মানুষ-হত্যা ততদূর পাপ বলে মনে করি না । মুসলমানের অন্ন খেয়েছে বলে শান্তি দিই, মুসলমানের সর্বনাশ করেছে বলে শাস্তি দিই নে । সমাজব্যবস্থার জন্য বাধাবাধি যে-নিয়ম হয়েছে সাহিত্য যদি তাকে সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা না করে সাহিত্যকে দোষ দিতে পারি না । কিন্তু, যে-সমস্ত নীতি মানুষের চরিত্রের মর্মগত সত্য, যেমন লোককে প্রতারণা করব না, ইত্যাদি সেগুলির ব্যতিক্রম কোনোকালে হতে পারে বলে মনে করি না । প্রভাত গঙ্গোপাধ্যায় ; কিন্তু তরুণীরা এই যে লিখেছেন, ভগবান প্রেম আর ভূত মানি না, সাহিত্যে তার স্থান আছে কি । রবীন্দ্রনাথ ; এ কথা পূর্বে বলেছি। মানুষ যেখানে জয়ী হয়েছে সেখানে সে যা পেয়েছে তার বেশি। দিয়েছে। ঐশ্বৰ্য বলতে এই বোঝায়, সে তার মূলধনের বাড়া । সেই ঐশ্বৰ্যই প্ৰকাশ পায় সাহিত্যে । স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধের মধ্যে ঐশ্বৰ্যই হচ্ছে প্ৰেম, কামনা নয় । কামনায় উদ্যবৃত্ত কিছু থাকে না । উদকৃত্তটাই নানা বর্ণে রূপে প্রেমে প্রকাশ পায় । লোভ-ক্রোধের প্রবলতার মধ্যেও প্রকাশের শক্তি আছে । যুদ্ধের মধ্যে, আঘাতের মধ্যে, নিষ্ঠুরতার মধ্যে আপনাকে সে প্রকাশ করতে পারে । বর্বরতার মধ্যেও সাহিত্যের প্রকাশযোগ্য কিছু আছে, সেটা কলুষ নয়, সেটা তেজ, শক্তি । অনেক সময় অতিসভ্য জাতির প্রাণশক্তিতে শৈথিল্যে যখন আসে তখন বাহির হতে বর্বরতার ক্রোধ ও হিংসা কাজে লাগে । অতিসভ্য জাতির চিত্ত যখন স্নান হয়ে আসে, চিরকালের জিনিস সে যখন কিছু দিতে পারে না, তখন তার দুৰ্গতি । গ্ৰীস যখন উন্নতির মধ্যগগনে ছিল তখন সে চিত্তেরই ঐশ্বৰ্য দিয়েছে, কামনা বা লালসার আভাস সেইসঙ্গে থাকলেও সেটা নগণ্য । স্রোতের সঙ্গে সঙ্গে যেমন পঙ্কিলতা প্রকাশ পায় এও সেইরূপ । স্রোত ক্ষীণ হয়ে পাক বড়ো হলেই বিপদ । একজন প্রশ্ন করলেন : আপনি সাহিত্য-সৃষ্টির আদর্শের কথা বললেন। সমালোচনারও এরকম কোনো আদর্শ আছে কি না । সাহিত্য-সমালোচনায় লগুড় ও ব্যক্তিগত গালাগালিই যদি একমাত্র জিনিস হয় তা হলে সেটা সাহিত্যের পক্ষে হিতজনক কি না । রবীন্দ্রনাথ ; এটা সাহিত্যিক নীতি-বিগৰ্হিত ! যে-সমালোচনার মধ্যে শান্তি নাই, যা কেবলমাত্র