পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

G NRSR রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী আঘাত দেয়, কেবলমাত্র অপরাধটুিকুর প্রতিই সমস্ত চিত্ত নিবিষ্ট করে, আমি তাকে ঠিক মনে করি নে । এরূপ সমালোচনার ভিতর একটা জিনিস আছে যা বস্তুত নিষ্ঠুরতা- এটা আমাকে পীড়ন করে । সাহিত্যিক অপরাধের বিচার সাহিত্যিক ভাবেই হওয়া উচিত । অর্থাৎ, রচনাকে তার সমগ্রতার দিক থেকে দেখতে হবে । অনেক সময়ে টুকরো করতে গেলেই এক জিনিস আর হয়ে যায় । সমগ্ৰ পটের মধ্যে যে-ছবি আছে পটটাকে ছিড়ে তার বিচার করা চলে না- অন্তত সেটা আর্টের বিচার নয় । সুবিচার করতে হলে যে-শান্তি মানুষের থাকা উচিত সেটা রক্ষা করে আমরা যদি আমাদের মত প্ৰকাশ করি তা হলে সে মতের প্রভাব অনেক বেশি হয়। বিচারশক্তির প্রেসটিজ শাসনশক্তির প্রেসটিজের চেয়ে অনেক বেশি । আমাদের গভমেন্টের কোনো কোনো ব্যবহারে প্রকাশ পায় যে, তার মতে শাসনের প্রবলতা প্ৰমাণ করবার জন্যে মারের মাত্রাটা ন্যায়ের মাত্রার চেয়ে বাড়ানো ভালো । আমরা বলি, সুবিচার করবার ইচ্ছাটা দণ্ডবিধান করবার ইচ্ছার চেয়ে প্ৰবল থাকা উচিত । সজনীকান্ত দাস : এখানে যে-আলোচনা হচ্ছে সেটা সম্ভবত ‘শনিবারের চিঠি” নিয়েই ? রবীন্দ্রনাথ ; ই, “শনিবারের চিঠি’ নিয়েই কথা হচ্ছে । ইহার পর “শনিবারের চিঠি’র আদর্শ, “শনিবারের চিঠি’র ‘মণিমুক্তার আধুনিক সাহিত্যিকদের সাহিত্যিক ও সামাজিক doctrine, তাহারা যাহা সৃষ্টি করিতেছেন তাহা আদপে সাহিত্য কি না, ইত্যাদি বিষয়ে নানা ভাবের আলোচনা হয় । এই আলোচনায় নীরদচন্দ্ৰ চৌধুরী, অপূর্বকুমার চন্দ, প্রশান্তচন্দ্ৰ মহলানবিশ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, প্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়, আমলচন্দ্ৰ হােম, প্রমথ চৌধুরী, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি যোগদান করেন । রবীন্দ্রনাথ ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে যাহা বলিয়াছেন তাহ পর পর লিখিত হইল । মণিমুক্ত সম্বন্ধে যা মনকে বিকৃত করে সেগুলিকে সংগ্রহ করে সকলের কাছে প্ৰকাশ করলে উদ্দেশ্যের বিপরীত দিকে যাওয়া হয় । আধুনিক সাহিত্য সম্বন্ধে যে-জিনিস বরাবর সাহিত্যে বর্জিত হয়ে এসেছে, যাকে কলুষ বলি, তাকেই চরম বর্ণনীয় বিষয় করে দেখানো এক শ্রেণীর আধুনিক সাহিত্যিকদের একটা বিশেষ লক্ষ্য । এবং এইটে অনেকে স্পর্ধার বিষয় মনে করেন । কেউ কেউ বলছেন, এ-সব প্রতিক্রিয়ার ফল । আমি বলবি প্রতিক্রিয়া কখনোই প্রকৃতিস্থতা নয়। তা ক্ষণস্থায়ী অবস্থা মাত্র প্রকাশ করে, তা চিরন্তন হতে পারে না । যেমনতরো কোনোসময় বাতাস গরম হয়ে প্রতিক্রিয়ায় ঝড় আসতে পারে অথচ কেউ বলতে পারেন না, এর পর থেকে বরাবর কেবল ঝড়ই উঠবে। ঈশ্বরকে মানি নে, ভালোবাসা মানি নে, সুতরাং আমরা সাহিত্যে বিশেষ কৌলীন্য লাভ করেছি, এমন কথা মনে করার চেয়ে মুঢ়তা আর কিছু হতে পারে না । ঈশ্বরকে মানি না বা বিশ্বাস করি না, সেটাতে সাহিত্যিকতা কোথায় । ভালোবাসা মানছি না, অতএব যারা ভালোবাসা মানে তাদেরকে অনেকদূর ছড়িয়ে গিয়েছি, সাহিত্য প্রসঙ্গে এ কথা বলে লাভ কী । “শনিবারের চিঠি’র সমালোচনা সম্বন্ধে “শনিবারের চিঠি” যদি সাহিত্যের সীমার মধ্যে থেকে বিশুদ্ধভাবে সম্পূর্ণভাবে সমালোচনার পথে অগ্রসর হন, তা হলে বেশি ফললাভ করবেন। এই আমার বিশ্বাস । যদি একান্তভাবে দোষ নির্ণয় করবার দিকে সমস্ত চিত্ত নিবিষ্ট করি তা হলে সেটা মাথায় চেপে যায়, তাতে শক্তির অপচয় ঘটে । শনিবারের চিঠিতে এমন সব লোকের সম্বন্ধে আলোচনা দেখেছি। ধারা সাহিত্যিক নন এবং জনগণের মধ্যেও যাদের বিশেষ প্রাধান্য নেই। তাদের ব্যক্তিগত বিশেষত্বকে অতি প্ৰকট করে যে-সব ছবি আঁকা হয় তাতে না সাহিত্যের না। সমাজের কোনো উপকার ঘটে । এর ফল হয় এই যে, যেখানে সাধারণের