পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে (SRG তাকে বিনা বিলম্বে চালের উপর থেকে নীচে গড়িয়ে মারে । মানুষকে উচ্চ চালের থেকে নীচে ভূমিসাৎ করবার ছুতো খুঁজে বেড়ানো, কেবল আফ্রিকায় নয়, আমাদের সাহিত্যেও প্রচলিত । এমনতরো সংকটসংকুল অবস্থায় জনসভার প্রধান আসন থেকে নিকৃতি লওয়া সংগত ; কেননা, এই প্ৰধান আসনগুলোই চালের উপরিতল, হিংস্রতা-উদবোধন করবার জায়গা । আমাদের ভারতবর্ষীয় প্রকৃতি কেবলমাত্র সাহিত্যের কৃতিত্বকে কোনো মানুষের পক্ষেই চরম লক্ষ্য বলে মানতে চায় না । একদা তাকে অতিক্রম করবার সাধনাও মনে রাখতে হবে । জীবনের পচিশ বছর লাগে কর্মের জন্যে প্রস্তুত হতে, কঁচা হাতকে পাকাবার কাজে । তার পরে পচিশ বছর পূর্ণ শক্তিতে কাজ করবার সময় । অবশেষে ক্ৰমে ক্রমে সেই কর্মের বন্ধন থেকে মুক্তি নেবার জন্যে আরো পচিশ বছর দেওয়া চাই। সংসারের পুরোপুরি দাবি মাঝখানটাতে ; আরম্ভেও নয়, শেষেও নয় । এই ছিল আমাদের দেশের বিধান । কিন্তু পশ্চিমের নীতিতে কর্তব্যটাই শেষ লক্ষ্য, যে-মানুষ কর্তব্য করে সে নয় । আমাদের দেশে কর্মের, যন্ত্রটাকে স্বীকার করা হয়েছে, কমীর আত্মাকেও । সংসারের জন্যে মানুষকে কাজ করতে হবে, নিজের জন্যে মানুষকে মুক্তি পেতেও হবে। কর্মকরতে করতে কর্মের অভ্যাস কঠিন হয়ে ওঠে এবং তার অভিমান । এক সময়ে কর্মের চলতি স্রোত আপনি বালির বাধ। আপনি বাধে, আর সেই বন্ধনের অহংকারে মনে করে সেই সীমাই চরম সীমা, তার উর্ধের্ব আর গতি নেই। এমনি করে ধর্মতন্ত্র যেমন সাম্প্রদায়িকতার প্রাচীর পাকা করে আপন সীমা নিয়েই গর্কিত হয়, তেমনি সকল প্রকার কর্মই একটা সাম্প্রদায়িকতার ঠাট গড়ে তুলে সেই সীমাটার শ্রেষ্ঠত্ব কল্পনা ও ঘোষণা করতে ভালোবাসে । সংসারে যত কিছু বিরোধ এই সীমায় সীমায় বিরোধ, পরস্পরের বেড়ার ধারে এসে লাঠালাঠি । এইখানেই যত ঈর্ষা বিদ্বেষ ও চিত্তবিকার । এই কলুষ থেকে সংসারকে রক্ষা করবার উপায় কর্ম হতে বেরিয়ে পড়বার পথকে বাধামুক্ত রেখে দেওয়া । সাহিত্যে একটা ভাগ আছে যেখানে আমরা নিজের অধিকারে কাজ করি, সেখানে বাহিরের সঙ্গে সংঘাত নেই। আর-একটা ভাগ আছে যেখানে সাহিত্যের পণ্য আমরা বাহিরের হাটে আনি, সেইখানেই হট্টগোল । একটা কথা স্পষ্ট বুঝতে পারছি, এমন দিন আসে যখন এইখানে গতিবিধি যথাসম্ভব কমিয়ে আনাই ভালো ; নইলে বাইরে ওড়ে ধুলোর ঝড়, নিজের ঘটে অশান্তি, নইলে জোয়ান লোকদের কনুয়ের ঠেলা গায়ে পড়ে পাজরের উপর অত্যাচার করতে থাকে । 兔 সাহিত্যলোকে বাল্যকাল থেকেই কাজে লেগেছি। আরম্ভে খ্যাতির চেহারা অনেককাল দেখি নি । তখনকার দিনে খ্যাতির পরিসর ছিল অল্প ; এইজন্যই বোধ করি, প্রতিযোগিতার পরুষতা তেমন উগ্ৰ ছিল না । আত্মীয়মহলে যে-কয়জন কবির লেখা সুপরিচিত ছিল, তাদের কোনোদিন লঙ্ঘন করব বা করতে পারব, এমন কথা মনেও করি নি। তখন এমন কিছু লিখি নি যার জোরে গৌরব করা চলে, অথচ এই শক্তিদৈন্যের অপরাধে ব্যক্তিগত বা কাব্যগত এমন কটুকটব্য শুনতে হয় নি যাতে সংকোচের কারণ ঘটে । সাহিত্যের সেই শিথিল শাসনের দিন থেকে আরম্ভ করে গদ্যে পদ্যে আমার লেখা এগিয়ে চলেছে, অবশেষে আজ সত্তর বছরের কাছে এসে পৌঁছলেম। আমার দ্বারা যী করা সম্ভব সমস্ত অভাব ক্রটি সত্বেও তা করেছি। তবু যতই করি।-না কেন আমার শক্তির একটা স্বাভাবিক সীমা আছে, সে কথা বলাই বাহুল্য । কারই বা নেই । এই সীমাটি দুই উপকূলের সীমা । একটা আমার নিজের প্রকৃতিগত, আর-একটা আমার সময়ের প্রকৃতিগত । জেনে এবং না-জেনে আমরা এক দিকে প্ৰকাশ করি নিজের স্বভাবকে এবং অন্য দিকে নিজের কালকে । রচনার ভিতর দিয়ে আপন হৃদয়ের যে-পরিতৃপ্তি সাধন করা যায়। সেখানে কোনো হিসাবের কথা চলে না । যেখানে কালের প্রয়োজন সাধন করি সেখানে হিসাবনিকাশের দায়িত্ব আপনি এসে পড়ে। সেখানে বৈতরণীর পারে চিত্রগুপ্ত খাতা নিয়ে বসে আছেন। ভাষায় ছন্দে নূতন শক্তি এবং ভাবে চিত্তের নূতন প্রসার সাহিত্যে নুতন যুগের অবতারণা করে । কী পরিমাণে তারই আয়োজন