পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(SV) রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী করা গেছে তার একটা জবাবদিহি আছে। কখন কালের পরিবর্তন ঘটে, সব সময়ে ঠিক বুঝতে পারি নি। নূতন ঋতুতে হঠাৎ নুতন ফুল-ফল-ফসলের দাবি এসে পড়ে। যদি তাতে সাড়া দিতে না পারা যায়। তবে সেই স্থাবরতাই স্থবিরত্ব প্রমাণ করে ; তখন কালের কাছ থেকে পারিতোষিকের আশা করা চলে না, তখনই কালের আসন ত্যাগ করবার সময় । যাকে বলছি কালের আসন সে চিরকালের আসন নয় । স্থায়ী প্ৰতিষ্ঠা স্থির থাকা সত্ত্বেও উপস্থিত কালের মহলে ঠাইবন্দলের হুকুম যদি আসে, তবে সেটাকে মানতে হবে । প্রথমটা গোলমাল ঠেকে । নতুন অভ্যাগতের নতুন আকারপ্রকার দেখে তাকে অভ্যর্থনা করতে বাধা লাগে, সহসা বুঝতে পারি নে- সেও এসেছে। বর্তমানের শিখর অধিকার করে চিরকালের আসন জয় করে নিতে । একদা সেখানে তারও স্বত্ব স্বীকৃত হবে, গোড়ায় তা মনে করা কঠিন হয় বলে এই সন্ধিক্ষণে একটা সংঘাত ঘটতেও পারে । মানুষের ইতিহাসে কাল সব সময়ে নূতন করে বাসা বদল করে না । যতক্ষণ দ্বারে একটা প্রবল বিপ্লবের ধাক্কা না লাগে ততক্ষণ সে খরচ বাঁচাবার চেষ্টায় থাকে, আপন পূর্বদিনের অনুবৃত্তি করে চলে, দীর্ঘকালের অভ্যস্ত রীতিকেই মাল্যচন্দন দিয়ে পূজা করে, অলসভাবে মনে করে সেটা সনাতন । তখন সাহিত্য পুরাতন পথেই পণ্য বহন করে চলে, পথনির্মাণের জন্য তার ভাবনা থাকে না । হঠাৎ একদিন পুরাতন বাসায় তার আর সংকুলান হয় না। অতীতের উত্তর দিক থেকে হাওয়া বওয়া বন্ধ হয়, ভবিষ্যতের দিক থেকে দক্ষিণ-হাওয়া চলতে শুরু করে । কিন্তু, বদলের হাওয়া বইল বলেই যে নিন্দার হাওয়া তুলতে হবে, তার কোনো কারণ নেই। পুরাতন আশ্রয়ের মধ্যে সৌন্দর্যের অভাব আছে, যে-অকৃতজ্ঞ অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে সেই কথা বলবার উপলক্ষ খোজে তার মন সংকীর্ণ, তার স্বভাব রাঢ় । আকবরের সভায় যে দরবারি আসর জন্মেছিল, নবদ্বীপের কীর্তনে তাকে খাটানো গেল না । তাই বলে দরবারি তোড়িকে গ্ৰাম্যভাষায় গাল পাড়তে বসা বর্বরতা। নূতন কালকে বিশেষ আসন ছেড়ে দিলেও দরবারি তোড়ির নিত্য আসন আপন মর্যাদায় অক্ষুধা থাকে। গোড়া বৈষ্ণব তাকে তাচ্ছিল্য করে যদি খাটাে করতে চায়। তবে নিজেকেই খাটাে করে। বক্তৃত নূতন আগন্তুককেই প্রমাণ করতে হবে, সে নূতন কালের জন্য নুতন অর্ঘ্য সাজিয়ে এনেছে কি না । কিন্তু, নূতন কালের প্রয়োজনটি ঠিক যে কী সে তার নিজের মুখের আবেদন শুনে বিচার করা চলে না, কারণ, প্রয়োজনটি অন্তনিহিঁত । হয়তো কোনো আশু উত্তেজনা, বাইরের কোনো আকস্মিক মোহ, তার অন্তৰ্গঢ় নীরব আবেদনের উলটাে কথাই বলে ; হয়তো হঠাৎ একটা আগাছার দুর্দমতা তার ফসলের খেতের প্রবল প্রতিবাদ করে ; হয়তো একটা মুদ্রাদোষে তাকে পেয়ে বসে, সেইটোকেই সে মনে করে শোভন ও স্বাভাবিক । আত্মীয়সভায় সেটাতে হয়তো বাহবা মেলে, কিন্তু সর্বকালের সভায় সেটাতে তার অসম্মান ঘটে । কালের মান রক্ষা করে চললেই যে কালের যথার্থ প্ৰতিনিধিত্ব করা হয়, এ কথা বলব না । এমন দেখা গেছে, যারা কালের জন্য সত্য অর্ঘ্য এনে দেন তারা সেই কালের হাত থেকে বিরুদ্ধ আঘাত পেয়েই সত্যকে সপ্ৰমাণ করেন । আধুনিক যুগে, যুরোপের চিত্তাকাশে যে হাওয়ার মেজাজ বদল হয় আমাদের দেশের হাওয়ায় তারই ঘূর্ণি-আঘাত লাগে । ভিক্টোরিয়া-যুগ জুড়ে সেদিন পর্যন্ত ইংলন্ডে এই মেজাজ প্ৰায় সমভাবেই ছিল । এই দীর্ঘকালের অধিক সময় সেখানকার সমাজনীতি ও সাহিত্যরীতি একটানা পথে এমনভাবে চলেছিল যে মনে হয়েছিল যে, এ ছাড়া আর গতি নেই । উৎকর্ষের আদর্শ একই কেন্দ্রের চারি দিকে আবর্তিত হয়ে প্রাগ্রসর উদ্যমকে যেন নিরস্ত করে দিলে । এই কারণে কিছুকাল থেকে সেখানে সমাজে, সাহিত্যকলাসৃষ্টিতে, একটা অধৈর্যের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। সেখানে বিদ্রোহী চিত্ত সব-কিছু উলট-পালট করবার জন্য কোমর বঁধিল, গানেতে ছবিতে দেখা দিল যুগাস্তের তাণ্ডবলীলা । কী চাই সেটা স্থির হল না, কেবল হাওয়ায় একটা রব উঠল “আর ভালো লাগছে না । যা-করে হোক আর কিছু-একটা ঘটা চাই । যেন সেখানকার ইতিহাসের একটা বিশেষ পর্ব মনুর বিধান মানতে চায় নি,