পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে @ՀԳ পঞ্চাশ পেরিয়ে গেল তবু ছুটি নিতে তার মন ছিল না। মহাকালের উন্মত্ত চরগুলো একটি একটি করে তার অঙ্গনে ক্ৰমে জুটতে লাগল ; ভাবখানা এই যে, উৎপাত করে ছুটি নেওয়াবেই। সেদিন তার আর্থিক জমার খাতায় ঐশ্বর্যের অঙ্কপাত নিরবচ্ছিন্ন বেড়ে চলেছিল । এই সমৃদ্ধির সঙ্গে শান্তি চিরকালের জন্যে বাধা, এই ছিল তার বিশ্বাস । মোটা মোটা লোহার সিন্ধুকগুলোকে কোনো-কিছুতে নড়াচড় করতে পারবে, এ কথা সে ভাবতেই পারে নি। এইজন্য একঘেয়ে উৎকর্যের বিরুদ্ধে অনিবাৰ্য চাঞ্চল্যকে সেদিনের মানুষ ঐ লোহার সিন্ধুকের ভরসায় দমন করবার চেষ্টায় ছিল । এমন সময় হাওয়ায় এ কী পাগলামি জাগল । একদিন অকালে হঠাৎ জেগে উঠে সবাই দেখে, লোহার সিন্ধুকে ভয়ংকর মাথা-ঠোকাঠুকি ; বহুদিনের সুরক্ষিত শান্তি ও পুঞ্জীভূত সম্বল ধুলোয় ধুলোয় ছড়াছড়ি ; সম্পদের জয়তোরণ তলার উপর তলা গেথে ইন্দ্ৰলোকের দিকে চূড়া তুলেছিল, সেই ঔদ্ধত্য ধরণীর ভারাকর্ষণ সইতে পারল না, এক মুহুর্তে হল ভূমিসাৎ । পুষ্টদেহধারী তুষ্টচিত্ত পুরাতনের মর্যাদা আর রইল না। নূতন যুগ আলুথালু বেশে অত্যন্ত হঠাৎ এসে পড়ল, তাড়াহুড়ো বেধে গেল, গোলমাল চলছে- সাবেক-কালের কর্তব্যক্তির ধমকানি আর কানে পৌছায় না। অস্থায়িত্বের এই ভয়ংকর চেহারা অকস্মাৎ দেখতে পেয়ে কোনো-কিছুর স্থায়িত্বের প্রতি শ্রদ্ধা লোকের একেবারে আলগা হয়ে গেছে । সমাজে সাহিত্যে কলারচনায় অবাধে নানাপ্রকারের অনাসৃষ্টি শুরু হল । কেউ-বা ভয় পায়, "কেউ-বাউৎসাহ দেয়, কেউ বলে “ভালো মানুষের মতো থামো, কেউ বলে "মরিয়া হয়ে চলো” । এই যুগান্তরের ভাঙচুরের দিনে র্যারা নূতন কালের নিগৃঢ় সত্যটিকে দেখতে পেয়েছেন ও প্ৰকাশ করছেন তারা যে কোথায়, তা এই গোলমালের দিনে কে নিশ্চিত করে বলতে পারে । কিন্তু, এ কথা ঠিক যে, যে-যুগ পঞ্চাশ পেরিয়েও তক্ত আঁকড়ে গদিয়ান হয়ে বসে ছিল, নূতনের তাড়া খেয়ে লোটাকম্বল হাতে বনের দিকে সে দৌড় দিয়েছে। সে ভালো কি এ ভালো সে তর্ক তুলে ফল নেই ; আপাতত এই কালের শক্তিকে সার্থক করবার উপলক্ষে নানা লোকে নব নব প্ৰণালীর প্রবর্তন করতে বসল। সাবেক প্ৰণালীর সঙ্গে মিল হচ্ছে না ব'লে যারা উদবেগ প্রকাশ করছে। তারাও ঐ পঞ্চাশোধের্বর দল, বনের পথ ছাড়া তাদের গতি নেই । তাই বলছিলেম, ব্যক্তিগত হিসাবে যেমন পঞ্চাশোধৰ্ব্বম আছে, কালগত হিসাবেও তেমনি । সময়ের সীমাকে যদি অতিক্রম করে থাকি তবে সাহিত্যে অসহিষ্ণুতা মথিত হয়ে উঠবে । নবাগত যারা তারা যে-পর্যন্ত নবযুগে নূতন আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করে নিজেরা প্রতিষ্ঠালাভ না করবেন সে-পর্যন্ত শান্তিহীন সাহিত্য কলুষ লিপ্ত হবে । পুরাতনকে অতিক্রম করে নূতনকে অভূতপূর্ব করে তুলবই, এই পণ করে বসে নবসাহিত্যিক যতক্ষণ নিজের মনটাকে ও লেখনীটাকে নিয়ে অত্যন্ত বেশি টানাটানি করতে থাকবেন, ততক্ষণ সেই অতিমাত্র উদবোজনায় ও আলোড়নে সৃষ্টিকার্যে অসম্ভব হয়ে উঠবে। যেটাকে মানুষ পেয়েছে, সাহিত্য তাকেই যে প্রতিবিম্বিত করে, তা নয় ; যা তার অনুপলব্ধ, তার সাধনার ধন, সাহিত্যে প্ৰধানত তারই জন্য কামনা উজ্জ্বল হয়ে ব্যক্তি হতে থাকে । বাহিরের কর্মে যে-প্রত্যাশা সম্পূর্ণ আকার লাভ করতে পারে নি, সাহিত্যে কলারচনায় তারই পরিপূর্ণতার কল্পরূপ নানা ভাবে দেখা দেয় । শাস্ত্ৰ বলে, ইচ্ছাই সত্তার বীজ | ইচ্ছাকে মারলে ভববন্ধন ছিন্ন হয় । ইচ্ছার বিশেষত্ব অনুসরণ করে আত্মা বিশেষ দেহ, ও গতি লাভ করে । বিশেষ যুগের ইচ্ছা, বিশেষ সমাজের ইচ্ছা, সেই যুগের সেই সমাজের আত্মরূপসৃষ্টির বীজশক্তি । এই কারণেই ধারা রাষ্টিক লোকগুরু তারা রাষ্ট্ৰীয় মুক্তির ইচ্ছাকে সর্বজনের মধ্যে পরিব্যাপ্ত করতে চেষ্টা করেন, নইলে মুক্তির সাধনা দেশে अठ° १२०ों की कीं । সাহিত্যে মানুষের ইচ্ছারাপ এমন করে প্রকাশ পায় যাতে সে মনোহর হয়ে ওঠে, এমন পরিস্ফুট মূর্তি ধরে যাতে সে ইন্দ্ৰিয়গোচর বিষয়ের চেয়ে প্রত্যয়গম্য হয়। সেই কারণেই সমাজকে সাহিত্য একটি সজীব শক্তি দান করে ; যে ইচ্ছা তার শ্ৰেষ্ঠ ইচ্ছা সাহিত্যযোগে তা শ্ৰেষ্ঠ ভাষায় ও ভঙ্গিতে দীর্ঘকাল ধরে মানুষের মনে কাজ করতে থাকে এবং সমাজের আত্মসৃষ্টিকে বিশিষ্টতা দান করে । রামায়ণ মহাভারত ভারতবাসী হিন্দুকে বহুযুগ থেকে মানুষ করে এসেছে। একদা ভারতবর্ষ যে-আদর্শ