পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Gł Rbr রবীন্দ্র-রচনাবলী কামনা করেছে তা ঐ দুই কাব্যে চিরজীবী হয়ে গেল। এই কামনাই সৃষ্টিশক্তি । বঙ্গদর্শনে এবং বঙ্কিমের রচনায় বাংলাসাহিত্যে প্রথম আধুনিক যুগের আদর্শকে প্রকাশ করেছে। তার প্রতিভার দ্বারা অধিকৃত সাহিত্য বাংলাদেশের মেয়ে পুরুষের মনকে এক কাল থেকে অন্য কালের দিকে ফিরিয়ে দিয়েছে ; এদের ব্যবহারে ভাষায় রুচিতে পূর্বকালবতী ভাবের অনেক পরিবর্তন হয়ে গেল। যা আমাদের ভালো লাগে, অগোচরে তাই আমাদের গড়ে তোলে । সাহিত্যে শিল্পকলায় আমাদের সেই ভালো-লাগার প্রভাব কাজ করে । সমাজ সৃষ্টিতে তার ক্রিয়া গভীর। এই কারণেই সাহিত্যে যাতে ভদ্রসমাজের আদর্শ বিকৃত নাহয়, সকল কালেরই এই দায়িত্ব । বঙ্কিম যে-যুগ প্রবর্তন করেছেন আমার বাস সেই যুগেই। সেই যুগকে তার সৃষ্টির উপকরণ জোগানো এ-পর্যন্ত আমার কাজ ছিল। য়ুরোপের যুগান্তর-ঘোষণার প্রতিধ্বনি ক’রে কেউ কেউ বলছেন, আমাদের সেই যুগেরও অবসান হয়েছে। কথাটা খাটি না হতেও পারে। যুগান্তরের আরম্ভে প্ৰদোষান্ধকারে তাকে নিশ্চিত করে চিনতে বিলম্ব ঘটে । কিন্তু, সংবাদটা যদি সত্যই হয় তবে এই যুগসন্ধ্যার যারা অগ্রদূত র্তাদের ঘোষণাবাণীতে শুকতারার সুরম্য দীপ্তি ও প্রত্যুষের সুনির্মল শান্তি আসুক ; নবযুগের প্রতিভা আপন পরিপূর্ণতার দ্বারাই আপনাকে সার্থক করুক, বাকচাতুর্যের দ্বারা নয়। রাত্রির চন্দ্ৰকে যখন বিদায় করবার সময় আসে তখন কুয়াশার কলুষ দিয়ে তাকে অপমানিত করবার প্রয়োজন হয় না, নবপ্ৰভাতের সহজ মহিমার শক্তিতেই তার অন্তর্ধান ঘটে । পথে চলতে চলতে মর্তলীলার প্রান্তবর্তী ক্লান্ত পথিকের এই নিবেদনপত্র সসংকোচে "তরুণসভায় প্রেরণ করলেম । এই কালের র্যারা অগ্ৰণী তাদের কৃতাৰ্থতা একান্তমনে কামনা করি । নবজীবনের অমৃতপাত্র যদি সত্যই তারা পূৰ্ণ ক’রে এনে থাকেন, আমাদের কালের ভাণ্ড আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে যদি রিক্ত হয়েই থাকে, আমাদের দিনের ছন্দ যদি এখনকার দিনের সঙ্গে নাই মেলে, তবে তার যথার্থ নূতন কাল সহজেই প্রমাণ করবেন— কোনো হিংস্রনীতির প্রয়োজন হবে না । নিজের আয়ুদৈর্ঘ্যের অপরাধের জন্য আমি দায়ী নই ; তবে সাস্তুনার কথা এই যে, সমাপ্তির জন্য বিলুপ্তি অনাবশ্যক । সাহিত্যে পঞ্চাশোধৰ্ব্বম নিজের তিরোধানের বন নিজেই সৃষ্টি করে, তাকে কৰ্কশকণ্ঠে তাড়না ক’রে বনে পাঠাতে হয় না । k፡ অবশেষে যাবার সময় বেদমন্ত্রে এই প্রার্থনাই করি- যদি ভদ্রং তন্ন আসুব ; যাহা ভদ্র তাহাই আমাদিগকে প্রেরণ করে । ফায়ুন ১৩৩৬ বাংলাসাহিত্যের ক্রমবিকাশ একদিন কলিকাতা ছিল অখ্যাত অসংস্কৃত পল্লী ; সেখানে বসল। বিদেশী বাণিজ্যের হাট, গ্রামের শ্যামল আবেষ্টন সরিয়ে দিয়ে শহরের উদ্ধত রূপ প্ৰকাশ পেতে লাগল। সেই শহর আধুনিক কালকে দিল আসন পেতে ; বাণিজ্য এবং রাষ্ট্রের পথে দিগন্তের পর দিগন্তে সেই আসন বিস্তৃত হয়ে চলল । এই উপলক্ষে বর্তমান যুগের বেগমন চিত্তের সংস্রব ঘটল বাংলাদেশে। বর্তমান যুগের প্রধান লক্ষণ এই যে, সে সংকীর্ণ প্রাদেশিকতায় বদ্ধ বা ব্যক্তিগত মূঢ় কল্পনায় জড়িত নয়। কি বিজ্ঞানে কি সাহিত্যে, সমস্ত দেশে সমস্ত কালে তার ভূমিকা | ভৌগোলিক সীমানা অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক সভ্যতা সর্বমানবচিত্তের সঙ্গে মানসিক দেনা-পাওনার ব্যবহার প্রশস্ত করে চলেছে । এক দিকে পণ্য এবং রাষ্ট্র-বিস্তারে পাশ্চাত্যমানুষ এবং তার অনুবতীদের কঠোর শক্তিতে সমস্ত পৃথিবী অভিভূত, অন্য দিকে পূর্ব-পশ্চিমে সর্বত্রই আধুনিক কালের প্রধান বাহন পাশ্চাত্যসংস্কৃতির অমোঘ প্রভাব বিস্তীৰ্ণ । বৈষয়িক ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের আক্ৰমণ আমরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রতিরোধ করতে পারি নি, কিন্তু পাশ্চাত্যসংস্কৃতিকে আমরা ক্ৰমে ক্রমে স্বতই স্বীকার করে নিচ্ছি। এই ইচ্ছাকৃত