পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালাতন্তর (V) কিছুই দোষের নয়। বরঞ্চ মুক্তকণ্ঠে বলতে পারি, তারই দায়িত্ব বড়ো, তারই আদর্শে তারই অপরাধ সকলের চেয়ে নিন্দনীয় । যে দুঃখী, যে অবমানিত, সে যেদিন ন্যায়ের দোহাইকে অত্যাচারের সিংহগর্জনের উপরে তুলে আত্মবিস্মৃত প্ৰবলকে ধিক্কার দ্রবার ভরসা ও অধিকার সম্পূৰ্ণহারাবে,সেই দিনই বুঝব এই যুগ আপনি শ্ৰেষ্ঠসম্পদে শেষকড়-পর্যন্ত দেউলে হল । তার পরে আসুক কল্পান্ত । se Y \o8o বিবেচনা ও অবিবেচনা বাংলা দেশে একদিন স্বদেশপ্রেমের বান ডাকিল ; আমাদের প্রাণের ধারা হঠাৎ অসম্ভব রকম ফুলিয়া উঠিয়া পাড়ি ছাপাইয়া পড়ে আর কি । সেই বেগটা যে সত্য তাহার প্রমাণ এই যে, তাহার চাঞ্চল্যে কেবল আমাদের কাগজের নৌকাগুলাকে দোলা দেয় নাই, কেবল সভাতলেই করতালির তুফান উঠিয়া সমস্ত চুকিয়া গেল না । সেদিন সমাজটাও যেন আগাগোড়া নড়িয়া উঠিল এমনতরো বোধ হইয়াছিল। এক মুহুর্তেই তীতের কাজে ব্ৰাহ্মণের ছেলেদের বাধা ছুটিয়া গেল। ভদ্রসন্তান কাপড়ের মোট বহিয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল, এমন-কি, হিন্দু-মুসলমানে একত্রে বসিয়া আহার করার আয়োজনটাও হয়-হয় করিতে व्लाकिळ । তর্ক করিয়া এ-সব হয় নাই- কেহ বিধান লইবার জন্য অধ্যাপকপাড়ায় যাতায়াত করে নাই। প্ৰাণ জাগিলেই কাহারো পরামর্শ না লইয়া। আপনি সে চলিতে প্ৰবৃত্ত হয় ; তখন সে চলার পথের সমস্ত বাধাগুলাকে কোলের কাছে টানিয়া লইয়া তাহাতে গভীরভাবে সিঁদুর চন্দন মাখাইতে বসে না, কিংবা তাহাকে লইয়া বসিয়া বসিয়া সুনিপুণ তত্ত্ব বা সুচারু কবিত্বের সূক্ষ্ম বুনানি বিস্তার করিতেও তাহার প্রবৃত্তি হয় না। যেমনি চলিতে যায় আমনি সে আপনিই বুঝিতে পারে কোনগুলা লইয়া তাহার চলিবে না ; তখন যাহা গায়ে ঠেকে তাহাকেই সমস্ত গা দিয়া সে ঠেলা দিতে শুরু করে । সেই সাবেক পাথরগুলা যখন ঠেলার চোটে টালিতে থাকে তখন বোঝা যায় প্ৰাণ জাগিয়াছে বটে, ইহা মায়া নহে স্বপ্ন নহে । সেই বন্যার বেগ কিমিয়া আসিয়াছে । সমাজের মধ্যে যে চলার বেঁক আসিয়াছিল সেটা কাটিয়া গিয়া আজ আবার বাধি বোলের বেড়া বাধিবার দিন আসিয়াছে । আজ আবার সমাজকে বাহবা দিবার পালা আরম্ভ হইল । জগতের মধ্যে কেবল-মাত্র ভারতেরই জলবাতাসে এমন একটি অদ্ভুত জাদু আছে যে এখানে রীতি আপনিই নীতিকে বরণ করিয়া লয়, আচারের পক্ষে বিচারের কোনো প্রয়োজনই হয় না। আমাদের কিছুই বানাইবার দরকার নাই কেবল মানিয়া গেলেই চলে, এই বলিয়া নিজেকে অভিনন্দন করিতে বসিয়াছি । যে-লোক কাজের উৎসাহে আছে, স্তবের উৎসাহে তাহার প্রয়োজনই থাকে না । ইহার প্রমাণ দেখো, আমরাও পশ্চিম সমুদ্রপারে গিয়া সেখানকার মানুবাদের মুখের উপর বলিয়া আসিয়াছি, “তোমরা মরিতে বসিয়াছ ! আত্মা বলিয়া পদার্থকে কেবলই বস্তুচাপা দিয়া তাহার দম বন্ধ করিবার জো করিয়াছ- তোমরা স্কুলের উপাসক।” এসব কঠোর কথা শুনিয়া তাহারা তো মারমূর্তি ধরে নাই। বরঞ্চ ভালোমানুষের মতো মানিয়া লইয়াছে ; মনে মনে বলিয়াছে, “হবেও বা । আমাদের বয়স অল্প, আমরা কাজ বুঝি- ইহারা অত্যন্ত প্ৰাচীন, অতএব কাজ কামাই করা সম্বন্ধে ইহারা যে তত্ত্বকথাগুলা বলে নিশ্চয় সেগুলা ইহারা আমাদের চেয়ে ভালোই বোঝে।” এই বলিয়া ইহারা আমাদিগকে দক্ষিণা দিয়া খুশি করিয়া বিদায় করিয়াছে এবং তাহার পর আস্তিন গুটািইয়া যেমন কাজ করিতেছিল। তেমনিই কাজ করিতে লাগিয়াছে ।