পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালতের @8@ সম্পূর্ণ নিরন্ত হইতে চায় না। কিন্তু তাহার মধ্যে একটি প্রবীণও আছে, বাধার বিকট চেহারা দেখিবা মাত্রই সে বলে, কাজ কী । বহু পুরাতন যুগ হইতে পুরুষানুক্রমে যত৷-কিছু বিপদের তাড়না আপনার ভয়ের সংবাদ রাখিয়া গিয়াছে অহাকে পুঁথির। আকারে বাধাইয়া রাখিয়া একটি বৃদ্ধ তাহারই খবরদারি করিতেছে। নবীন প্ৰাণ এবং প্ৰবীণ ভয়, জীবের মধ্যে উভয়েই কাজ করিতেছে । ভয় বলিতেছে ‘রোসো রোসো, প্ৰাণ বলিতেছে “দেখাই যাক-না” । অতএব এই প্ৰবীণতায় বিরুদ্ধে আমরা আপত্তি করিবার কে । আপত্তি করিও না । তাহার বৈঠকে তিনি গদিয়ান হইয়া থাকিবেন, সেখান হইতে তাহাকে আমরা নড়িয়া বসিতে বলি এমন বেআদব আমরা নই। কিন্তু প্ৰাণের রাজ্যে তঁহাকেই একেশ্বর করিবার যখন ষড়যন্ত্র হয় তখনই বিদ্রোহের ধবজা তুলিয়া বাহির হইবার দিন আসে । দুর্ভাবনা এবং নির্ভাবনা উভয়কেই আমরা খাতির করিয়া চলিতে রাজি আছি । প্ৰাণের রাজ্যাধিকারে এই উভয়েই শরিক বটে। কিন্তু উভয়ের অংশ যে সমান তাহাও আমরা মানিতে পারি না । নিৰ্ভাবনার অংশটাই বেশি হওয়া চাই নহিলে স্রোত এতই মন্দ বহে যে শেওলা জমিয়া জলটা চাপা পড়ে। মৃত্যুসংখ্যার চেয়ে জন্মসংখ্যা বেশি হওয়াই কল্যাণের লক্ষণ । পৃথিবীতে বারো আনা জল চার আনা স্থল। এরপ বিভাগ না হইলে বিপদ ঘটিত । কারণ জলই পৃথিবীতে গতিসঞ্চার করিতেছে, প্রাণকে বিস্তারিত করিয়া দিতেছে। জলই খাদ্যকে সচল করিয়া গাছপালা পশুপক্ষীকে স্তন্য দান করিতেছে । জলই সমুদ্র হইতে আকাশে উঠিতেছে, আকাশ হইতে পৃথিবীতে নামিতেছে, মলিনকে ধৌত করিতেছে, পুরাতনকে নূতন ও শুষ্ককে সরস করিয়া তুলিতেছে। পৃথিবীর উপর দিয়া যে জীবের প্রবাহ নব নব ধারায় চলিয়াছে তাহার মূলে এই জলেরই ধারা । স্থলের একাধিপত্য যে কী ভয়ংকর তাহা মধ্য-এশিয়ার মরুপ্রান্তরের দিকে তাকাইলেই বুঝা যাইবে । তাহার আচলতার তলে কত বড়ো বড়ো শহর লুপ্ত হইয়া গিয়াছে। যে পুরাতন পথ বাহিয়া ভারতবর্ষ হইতে চীনে জাপানে পণ্য ও চিত্ত-বিনিময় চলিত, এই রুদ্র মরু সে-পথের চিহ্ন মুছিয়া দিল ; কত যুগের প্রাণচঞ্চল ইতিহাসকে বালুচাপা দিয়া সে কঙ্কালসার করিয়া দিয়াছে । উলঙ্গ ধূর্জটি সেখানে এক স্থাণু হইয়া উর্ধর্বনেত্ৰে বসিয়া আছেন ; উমা নাই । দেবতারা তাই প্ৰমাদ গনিতেছেন- কুমারের জন্ম হইবে কেমন করিয়া ! নূতন প্ৰাণের বিকাশ হইবে কী উপায়ে । জোঁর করিয়া চোখ বুজিয়া যদি না থাকি তবে নিজের সমাজের দিকে তাকাইলেও এই চেহারাই দেখিতে পাইব । এখানে স্থলের স্থাবরতা ভয়ংকর হইয়া বসিয়া আছে- এ যে পাককেশের শুভ্র মরুভূমি। এখানে এককালে যখন প্ৰাণের রস বাহিত তখন ইতিহাস সজীব হইয়া সচল হইয়া কেবল যে এক প্রদেশ হইতে আর-এক প্রদেশে ব্যাপ্ত হইত। তাহা নহে- মহতী স্রোতস্বিনীর মতো দেশ হইতে দেশান্তরে চলিয়া যাইত । বিশ্বের সঙ্গে সেই প্ৰাণবিনিময়ের সেই পণ্যবিনিময়ের ধারা ও তাহার বিপুল রাজপথ কবে কোনকালে বালুচাপ পড়িয়া গেছে। এখানে-সেখানে মাটি খুঁড়িয়া বাহনদের কঙ্কাল খুঁজিয়া পাওয়া যায়, পুরাতত্ত্ববিদের খনিত্রের মুখে পণ্যসামগ্ৰীীর দুটাে-একটা ভাঙাটুকরা উঠিয়া পড়ে । গুহাগহবরে গহনে সেকালের শিল্পপ্রবাহিণীর কিছু কিছু অংশ আটকা পড়িয়া গেছে, কিন্তু আজ তাহা স্থির, তাহার ধারা নাই । সমস্ত স্বপ্নের মতো মনে হয় । আমাদের সঙ্গে ইহাদের সম্বন্ধ কী । সমস্ত সৃষ্টির স্রোত বন্ধ । যাহা আছে তাহা আছে, যাহা ছিল তাহা কেবলই তলাইয়া যাইতেছে। চারি দিক এমনি নিস্তবন্ধ নিশ্চল যে মনে ভ্ৰম হয় ইহাই সনাতন। কখনোই নহে, ইহাই নূতন । এই মরুভূমি সনাতন নহে, ইহার বহুপূর্বে এখানে প্ৰাণের নব নব লীলা চলিত— সেই লীলায় কত বিজ্ঞান দর্শন, শিল্প সাহিত্য, রাজ্য সাম্রাজ্য, কত ধর্ম ও সমাজবিপ্লব তরঙ্গিত হইয়া উঠিয়াছে। কিছু না করিয়া একবার মহাভারতটা পড়িয়া দেখিলেই দেখা যাইবে, সমাজটা কোনো সংহিতার কারখানাঘরের ঢলাই-পেটাই করা ও কারিগরের ছাপমারা সামগ্ৰী ছিল না— তাহাতে বিধাতার নিজের সৃষ্টির সমস্ত লক্ষণ ছিল, কেননা তাহাতে প্ৰাণ ছিল । তাহা নিখুঁত নয়, নিটােল নয় ; তাহ সজীব, তাহা প্রবল, তাহা কৌতুহলী, তাহা দুঃসাহসিক ।