পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(8tr • রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ঘাস সে ফুল সুন্দর এ কথা কেহই অস্বীকার করিবে না। কিন্তু পথের সৌন্দর্য ঘাসেও নহে ফুলেও নহে, তাহা বাধাহীন বিচ্ছেদহীন বিস্তারে ; তাহা ভ্ৰমণগুঞ্জনে নহে। কিন্তু পথিকদলের অক্লান্ত পদধ্বনিতেই রমণীয় । kee SOSS লোকহিত লোকসাধারণ বলিয়া একটা পদার্থ আমাদের দেশে আছে এটা আমরা কিছুদিন হইতে আন্দাজ করিতেছি এবং এই লোকসাধারণের জন্য কিছু করা উচিত হঠাৎ এই ভাবনা আমাদের মাথায় চাপিয়াছে। যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধিৰ্ভবতি তাদৃশী । এই কারণে, ভাবনার জন্যই ভাবনা হয় । আমরা পরের উপকার করিব মনে করিলেই উপকার করিতে পারি না । উপকার করিবার অধিকার থাকা চাই । যে বড়ো সে ছোটাের অপকার অতি সহজে করিতে পারে। কিন্তু ছোটাের উপকার করিতে হইলে কেবল বড়ো হইলে চলিবে না, ছোটাে হইতে হইবে, ছোটাের সমান হইতে হইবে । মানুষ কোনোদিন কোনো যথার্থ হিতকে ভিক্ষারূপে গ্ৰহণ করিবে না, ঋণরূপেও না, কেবলমাত্র প্রাপ্য বলিয়াই গ্ৰহণ করিতে পরিবে । কিন্তু আমরা লোকহিতের জন্য যখন মাতি তখন অনেক স্থলে সেই মত্ততার মূলে একটি আত্মাভিমানের মদ থাকে। আমরা লোকসাধারণের চেয়ে সকল বিষয়ে বড়ো এই কথাটাই রাজকীয় চালে সম্ভোগ করিবার উপায় উহাদের হিত করিবার আয়োজন । এমন স্থলে উহাদেরও অহিত করি, নিজেদেরও হিত করি না । হিত করিবার একটিমাত্র ঈশ্বরদত্ত অধিকার আছে, সেটি প্রীতি । প্রীতির দানে কোনো অপমান নাই কিন্তু হিতৈষিতার দানে মানুষ অপমানিত হয় । মানুষকে সকলের চেয়ে নত করিবার উপায় তাহার হিত করা অথচ তাহাকে প্রীতি না-করা । এ কথা অনেক সময়েই শোনা যায় যে, মানুষ স্বভাবতই অকৃতজ্ঞ- যাহার কাছে সে ঋণী তাহাকে পরিহার করিবার জন্য তাহার চেষ্টা । মহাজনো যেন গতঃ সা পন্থাঃ- এ উপদেশ পারতপক্ষে কেহ। মানে না । তাহার মহাজনটি যে-রাস্তা দিয়া চলে মানুষ সে-রাস্তায় চলা একেবারে ছাড়িয়া দেয় । ইহার কারণ এ নয় যে, স্বভাবতই মানুষের মনটা বিকৃত । ইহার কারণ এই যে, মহাজনকে সুদ দিতে হয় । সে-সুদ আসলকে ছাড়াইয়া যায়। হিতৈষী যে সুদটি আদায় করে সেটি মানুষের আত্মসম্মান ; সেটিও লইবে আবার কৃতজ্ঞতাও দাবি করিবে সে যে শাইলকের বাড়া হইল । সেইজন্য, লোকহিত করায় লোকের বিপদ আছে সে কথা ভুলিলে চলিবে না। লোকের সঙ্গে আপনাকে পৃথক রাখিয়া যদি তাহার হিত করিতে যাই। তবে সেই উপদ্রব লোকে সহ্য না করিলেই তাহাদের হিত হইবে । অল্পদিন হইল এ সম্বন্ধে আমাদের একটা শিক্ষা হইয়া গেছে। যে কারণেই হউক যেদিন স্বদেশী নিমকের প্রতি হঠাৎ আমাদের অত্যন্ত একটা টান হইয়াছিল সেদিন আমরা দেশের মুসলমানদের কিছু অস্বাভাবিক উচ্চস্বরেই আত্মীয় বলিয়া ভাই বলিয়া ডাকাডাকি শুরু করিয়াছিলাম । সেই মেহের ডাকে যখন তাহারা অশ্রাগদগদ কষ্ঠে সাড়া দিল না। তখন আমরা তাহাদের উপর ভারি রাগ করিয়াছিলাম। ভাবিয়ছিলাম। এটা নিতান্তই ওদের শয়তানি । একদিনের জন্যও ভাবি নাই, আমাদের ডাকের মধ্যে গরজ ছিল কিন্তু সত্য ছিল না । মানুষের সঙ্গে মানুষের যে একটা সাধারণ সামাজিকতা আছে, যে সামাজিকতার টানে আমরা সহজ প্রীতির বশে মানুষকে ঘরে ডাকিয়া আনি, তাহার সঙ্গে বসিয়া খাই, যদি-বা তাহার সঙ্গে আমাদের পার্থক্য থাকে সেটাকে অত্যন্ত স্পষ্ট করিয়া