পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

6:62 \9 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ইংলন্ডে এক সময় ছিল, যখন এক দিকে তার রাষ্ট্রযন্ত্রটা পাকা হইয়া উঠিতেছে এমন সময়েই প্রটেস্ট্যান্ট ও রোমান ক্যাথলিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলিতেছিল। সেই দ্বন্দ্বে দুই সম্প্রদায় যে পরস্পরের প্রতি বরাবর সুবিচার করিয়াছে তাহা নহে। এমনকি, বহুকাল পর্যন্ত ক্যাথলিকরা বহু অধিকার হইতে বঞ্চিত হইয়াই কাটাইয়াছে। আজও কোনো বিশেষ একটি সাম্প্রদায়িক চার্চের ব্যয়ভার ইংলন্ডের সমস্ত লোককে বহন করিতে হইতেছে, সে-দেশের অন্য সম্প্রদায়গুলির প্রতি ইহা অন্যায় । অশান্তি ও অসাম্যের এই বাহ্যিক ও মানসিক কারণগুলি আজ ইংলন্ডে নিরুপদ্রব হইয়া উঠিয়াছে কেন । যেহেতু সেখানে সমস্ত দেশের লোকে মিলিয়া একটি আপন শাসনতন্ত্ৰ পাইয়াছে। এই শাসনভার যদি সম্পূর্ণ বিদেশীর পরে থাকিত তবে যেখানে জোড়া মেলে নাই। সেখানে ক্রমাগত ঠোকাঠুকি বাধিয়া বিচ্ছেদ স্থায়ী হইত। একদিন ব্রিটিশ পলিটিক্সে স্কটল্যান্ড ও ইংলন্ডের বিরোধ কম তীব্র ছিল না । কেননা উভয় জাতির মধ্যে ভাষা ভাব রুচি প্রথা ও ঐতিহাসিক স্মৃতিধারার সত্যকারই পার্থক্য ছিল । দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়াই দ্বন্দ্ব ক্ৰমে ঘুচিয়াছে। এই দ্বন্দ্ব ঘুচিবার প্রধান কারণ এই যে, ইংরেজ ও স্কচ উভয়েই একটা শাসনতন্ত্ৰ পাইয়াছে যাহা উভয়েরই স্বাধিকারে ; যাহাতে সম্পদে ও বিপদে উভয়েরই শক্তি সমান কাজ করিতেছে । ইহার ফল হইয়াছে এই যে, আজ ইংলন্ডে স্কটিশ চার্চে ও ইংলিশ চার্চে প্ৰভেদ থাকিলেও, রোমান ক্যাথলিকে প্রটেস্ট্যান্টে অনৈক্য ঘটিলেও, রাষ্ট্ৰতন্ত্রের মধ্যে শক্তির ঐক্যে মঙ্গলসাধনের যোগে তাহাদের মিলন ঘটিয়াছে। ইহাদের মাথার উপর একটি তৃতীয় পক্ষ যদি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র থাকিয়া আপন ইচ্ছামত ইহাদিগকে চালনা করিত, তাহা হইলে কোনোকালেই কি ইহাদের জোড় মিলিত । আয়ার্লন্ডের সঙ্গে আজ পর্যন্ত ভালো করিয়া জোড় মেলে নাই কেন । অনেকদিন পর্যন্তই আয়ার্লন্ডের সঙ্গে ইংলন্ডের রাষ্ট্রীয় অধিকারের সাম্য ছিল না বলিয়া । এ কথা মানিতেই হইবে আমাদের দেশে ধর্ম লইয়া হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে একটা কঠিন বিরুদ্ধতা আছে । যেখানে সত্যভ্ৰষ্টতা সেইখানেই অপরাধ, যেখানে অপরাধ সেইখানেই শান্তি । ধর্ম যদি অন্তরের জিনিস না হইয়া শাস্ত্রমত ও বাহ্য আচারকেই মুখ্য করিয়া তোলে। তবে সেই ধর্ম যত বড়ো অশান্তির কারণ হয়, এমন আর-কিছুই না । এই “ডগমা অর্থাৎ শাস্ত্রমতকে বাহির হইতে পালন-করা লইয়া যুরোপের ইতিহাস কতবার রক্তে লাল হইয়াছে। অহিংসাকে যদি ধর্ম বলো, তবে সেটাকে কর্মক্ষেত্রে দুঃসাধ্য বলিয়া ব্যবহারে না মানিতে পারি, কিন্তু বিশুদ্ধ আইডিয়ালের ক্ষেত্রে তাহাকে স্বীকার করিয়া ক্ৰমে সে দিকে অগ্রসর হওয়া অসম্ভব নহে। কিন্তু বিশেষ শাস্ত্ৰমতের অনুশাসনে বিশেষ করিয়া যদি কেবল বিশেষ পশুহত্যা না করাকেই ধর্ম বলা যায় এবং সেইটো জোর করিয়া যদি অন্য ধর্মমতের মানুষকেও মানাইতে চেষ্টা করা হয়, তবে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিরোধ কোনোকালেই মিটিতে পারে না । নিজে ধর্মের নামে পশুহত্যা করিব অথচ অন্যে ধর্মের নামে পশুহত্যা করিলেই নরহত্যার আয়োজন করিতে থাকিব, ইহাকে অত্যাচার ছাড়া আর-কোনো নাম দেওয়া যায় না । আমাদের আশা এই যে, চিরদিন আমাদের ধর্ম আচারপ্রধান হইয়া থাকিবে না । আরো-একটি আশা আছে, একদিন হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে দেশহিতসাধনের একই রাষ্ট্ৰীয় আইডিয়ােল যদি আমাদের রাষ্ট্ৰতন্ত্রে বাস্তব হইয়া উঠে। তবে সেই অন্তরের যোগে বাহিরের সমস্ত পার্থক্য তুচ্ছ হইয়া যাইবে । অল্পদিন হইল, রেলগাড়িতে আমার এক ইংরেজ সঙ্গী জুটিয়াছিল । তিনি বেহার অঞ্চলের হাঙ্গামার প্রসঙ্গে গল্প করিলেন- সাহাবাদে কিংবা কোনো একটা জায়গায় ইংরেজ কাপ্তেন সেখানকার এক জমিদারকে বিদুপ করিয়া বলিয়াছিলেন, “তোমার রায়তদের তোমরা তো ঠেকাইতে পারিলে না । তোমরাই আবার হােমরুল চাও ” জমিদার কী জবাব করিলেন শুনি নাই। সম্ভবত তিনি লম্বা সেলাম করিয়া বলিয়াছিলেন, “না সাহেব, আমরা হােমরুল চাই না, আমরা অযোগ্য অধম । আপাতত আমার রায়তদের তুমি ঠেকাও ৷” বেচারা জানিতেন হােমরুল তখন সমুদ্রপারের স্বপ্নলোকে, কাপ্তেন ঠিক সম্মুখেই, আর হাঙ্গামাটা কাধের উপর চড়িয়া বসিয়াছে। আমি বলিলাম, “হিন্দু-মুসলমানের এই দাঙ্গাটা হােমরুলের অধীনে তো ঘটে নাই। নিরস্ত্ৰ জমিদারটি অক্ষমতার অপবাদে বোধ করি একবার সেনাপতি-সাহেবের ফৌজের দিকে নীরবে ,