পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○○ ケ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী কিন্তু জনসাধারণকে আশ্রয় দেন না । ক্রিয়াকর্মে খরচপত্র বাড়িয়াছে বৈ কমে নাই, অথচ সেই বিপুল অর্থব্যয়ে সমাজ-ব্যবস্থাকে ধারণ ও পোষণের জন্য নয়, তাহ রীতিরক্ষা ও সমারোহ করিবার জন্য । ইহাতে দেশের ধনীদরিদ্র সকলেই পীড়া বোধ করে । এ দিকে দলাদলি, জাতে ঠেলাঠেলি, পুঁথির বিধান বেচাকেনা প্রভৃতি সমস্ত উৎপীড়নই আছে। যে-গভীর বাধা খোরাক জোগাইতেছি সে দুধ দেওয়া প্ৰায় বন্ধ করিল, কিন্তু বাকা শিঙের ওঁতা মারাটা তার কমে নাই । য়ে-ব্যবস্থা সমাজের ভিতরে ছিল সেটা বাহিরে আসিয়া পড়াতে সুব্যবস্থা হইল কি না সেটা লইয়া তর্ক নয়। মানুষ যদি কতকগুলা পাথরের টুকরা হইত। তবে তাহাকে কেমন করিয়া শৃঙ্খলাবদ্ধরূপে সাজাইয়া কাজে লাগানো যায়। সেইটেই সব চেয়ে বড়ো কথা হইত। কিন্তু মানুষ যে মানুষ । তাকে বঁাচিতে হইবে, বাড়িতে হইবে, চলিতে হইবে । তাই এ কথাটা মানিতেই হইবে যে, দেশের সম্বন্ধে দেশের লোকের চেষ্টাকে নিরুদ্ধ করিয়া যে নিরানন্দের জড়ভার দেশের বুকে চাপিয়া বসিতেছে সেটা শুধু যে নিষ্ঠুর তাহা নহে, সেটা রাষ্ট্রনীতি হিসাবে নিন্দনীয়। আমরা যে-অধিকার চাহিতেছি তাহা ঔদ্ধত্য করিবার বা প্ৰভুত্ব করিবার অধিকার নাহে ; আমরা সকল ক্ষুধাতুরকে ঠেকাইয়া জগৎসংসারটাকে একলা দুহিয়া লইবার জন্য লম্বা লাঠি কঁধে লইতে চাই না ; যুদ্ধে নরঘাত সম্বন্ধে বিশ্বের সকলের চেয়ে বড়ো শক্তি, বড়ো উদ্যোগ ও বড়ো উৎসাহ রাখি বলিয়া শয়তানকে লজা দিবার দুরাকাঙক্ষা আমাদের নাই ; নিরীহ হিন্দু বলিয়া প্রবল পশ্চিম আমাদের উপরে যে-শ্লেষ প্রয়োগ করে তাহাকেই তিলক করিয়া আমাদের ললাটকে আমরা লাঞ্ছিত রাখিব ; আধ্যাত্মিক বলিয়া আমাদের আধুনিক শাসনকর্তারা আমাদের পরে যে কটাক্ষবর্ষণ করিয়াছেন তারই শরশয্যায় শেষ পর্যন্ত শয়ন থাকিতে আমরা দুঃখ বোধ করিব না- আমরা কেবলমাত্র আপনি দেশের সেবা করিবার, তার দায়িত্বগ্রহণ করিবার স্বাভাবিক অধিকার চাই । এই অধিকার হইতে ভ্ৰষ্ট হইয়া আশাহীন অকৰ্মণ্যতার দুঃখ ভিতরে ভিতরে অসহ্য হইয়াছে। এইজন্যই সম্প্রতি জনসেবার জন্য আমাদের যুবকদের মধ্যে একটা প্ৰবল আগ্রহ দেখিতে পাই। নিরাপদ শান্তির আওতায় মানুষ বঁাচে না । কেননা যেটা মানুষের অন্তরতম আবেগ তাহা বাড়িয়া চলিবার আবেগ । মহৎ লক্ষ্যের প্রতি আত্মোৎসর্গ করিয়া দুঃখ স্বীকার করাই সেই বাড়িয়া চলিবার গতি । সকল বড়ো জাতির ইতিহাসেই এই গতির দুনিবার আবেগ ব্যর্থতা ও সার্থক্যের উপলবন্ধুর পথে গর্জিয়া ফেনাইয়া, বাধা ভাঙিয়া চুরিয়া, ঝরিয়া পড়িতেছে। ইতিহাসের সেই মহৎ দৃশ্য আমাদের মতো পোলিটকাল পঙ্গুদের কাছ হইতেও আড়াল করিয়া রাখা অসম্ভব । এইজন্য যে-সব যুবকের প্রকৃতিতে প্ৰাণের স্বাভাবিক উত্তেজনা আছে, মহতের উপদেশ ও ইতিহাসের শিক্ষা হইতে প্রেরণা লাভ করা সত্ত্বেও নিশ্চেষ্ট হইয়া থাকা তাদের কাছে যে মৃত্যুর চেয়ে দারুণতর, সে কথা আত্মহত্যাকালে শচীন্দ্ৰ দাশগুপ্তের মর্মান্তিক বেদনার পত্ৰখানি পড়িলেই বুঝা যাইবে । কিন্তু কেবল ক্ষণে ক্ষণে বন্যাদুর্ভিক্ষের নৈমিত্তিক উপলক্ষে অন্তরগুঢ় সমস্ত শুভচেষ্টা নির্মুক্ত হইতে পারে না। দেশব্যাপী নিত্যকর্মের মধ্যেই মানুষের বিচিত্ৰশক্তি বিচিত্ৰভাবে সফল হয়। নতুবা তার অধিকাংশই বদ্ধ হইয়া আন্তরিক নৈরাশ্যের উত্তাপে বিকৃত হইতে থাকে । এই বিকার হইতে দেশে নানা গোপন উপদ্রবের সৃষ্টি । এইজন্য দেখা যায় দেশের ধর্মবুদ্ধি ও শুভচেষ্টার প্রতিই কর্তৃপক্ষের সন্দেহ সুতীব্ৰ । যে-লোক স্বার্থপর বেইমান, যে-উদাসীন নিশ্চেষ্ট, বর্তমানের গুপ্ত ব্যবস্থায় তারই জীবনযাত্রা সকলের চেয়ে নিরাপদ, তারই উন্নতি ও পুরস্কারের পথে সকলের চেয়ে বাধা অল্প । নিঃস্বার্থ পরহিতৈষিতার জবাবদিহি ভয়ংকর হইয়াছে। কেননা সন্দিগ্ধের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন যে, মহৎ অধ্যবসায়ে তোমার দরকার কী । তুমি খাইয়া-দাইয়া বিয়া-থাওয়া করিয়া আপিসে আদালতে ঘুরিয়া মোটা বা সরু মাহিনায় যখন স্বচ্ছন্দে দিন কাটাইতে পাের, তখন ঘরের খাইয়া বনের মোষ তাড়াইতে যাও কেন । বস্তুত কর্তৃপক্ষ জানেন, এই আলো এবং ঐ ধোয়া একই কারণ হইতে উঠিতেছে। সে কারণটা, নিক্রিয়তার অবসাদ হইতে দেশের শুভবুদ্ধির মুক্ত হইবার চেষ্টা । যুক্তিশাস্ত্ৰে বলে, পর্বতে বহ্নিমান ধূমাৎ । গুপ্তচরের যুক্তি বলে, পর্বতে ধূমাবান বহ্নেঃ । কিন্তু যাই বলুক। আর যাই করুক, মাটির তলায় ঐ যে দারুণ সুড়ঙ্গপথ খোলা হইল, যেখানে আলো নাই, শব্দ নাই, বিচার নাই,