পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর 663 নিস্কৃতির কোনো বৈধ উপায় নাই, এইটেই কি সুপথ হইল। দেশের ব্যাকুল চেষ্টাকে বিনা বাছনিতে একদমে কবরস্থ করিলে তার প্রেতের উৎপাতকে কি কোনোদিন শান্ত করিতে পরিবে । ক্ষুধার ছটফটানিকে বাহির হইতে কানমলা দিয়া ঠাণ্ডা করিয়া চিরদুৰ্ভিক্ষকে ভদ্র আকার দান করাই যে যথার্থ ভদ্রনীতি এমন কথা তো বলিতে পারিই না, তাহা যে বিজ্ঞনীতি তাহাও বলা যায় না । এইরকম চোরা-উৎপাতের সময় সমুদ্রের ওপার হইতে খবর আসিল, আমাদিগকে দান করিবার জন্য স্বাধীন শাসনের একটা খসড়া তৈরি হইতেছে । মনে ভাবিলাম কর্তৃপক্ষ বুঝিয়াছেন যে, শুধু দমনের বিভীষিকায় অশান্তি দূর হয় না, দক্ষিণ্যেরও দরকার। দেশ আমার দেশ, সে তো কেবল এখানে জন্সিয়াছি বলিয়াই নয়, এ দেশের ইতিহাসসৃষ্টি-ব্যাপারে আমার তপস্যার উপরে সমস্ত দেশের দাবি আছে বলিয়াই এ দেশ আমার দেশ, এই গভীর মহত্ত্ববোধ যদি দেশের লোক অনুভব করিবার উৎসাহ পায় তবেই এ দেশে ইংরেজ-রাজত্বের ইতিহাস গীেরবান্বিত হইবে । কালক্রমে বাহিরে সে ইতিহাসের অবসান ঘটিলেও অন্তরে তাহার মহিমা স্মরণীয় হইয়া থাকিবে । তা ছাড়া নিরতিশয় দুর্বলেরও প্রতিকূলতা নীেকার ক্ষুদ্রতম ছিদ্রের মতো । শান্তির সময় নিরন্তর জল সেঁচিয়া সেই ফাটা নীেকা বাওয়া যায়, কিন্তু তুফানের সময় যখন সকল হাতই দাড়ে হালে পালে আটক থাকে তখন তলার অতিতুচ্ছ ফাটলগুলিই মুশকিল বাধায় । রাগ করিয়া তার উপরে পুলিসের রেগুলেশন বা নন-রেগুলেশন লাঠি ঠুকিলে ফাটল কেবল বাড়িতেই থাকে। ফ্যাকগুলিকে বুজাইবার জন্য সময়-মত সামান্য খরচ করিলে কালক্রমে অসামান্য খরচ বঁাচে । এই কথা যে ইংলন্ডের মনীষী রাষ্ট্রনৈতিকেরা বুঝিতেছেন না। তাহা আমি মনে করি না । বুঝিতেছেন বলিয়াই হােমরুলের কথাটা উঠিয়াছে। কিন্তু রিপু অন্ধ ; সে উপস্থিত কালকেই বড়ো করিয়া দেখে, অনাগতকে উপেক্ষা করে। ধর্মের দোহাইকে সে দুর্বলতা এবং শৌখিন ভাবুকতা বলিয়া অবজ্ঞা করে । অভাবনীয় প্রত্যাশার আনন্দে উৎফুল্প হইয়া ইংরেজের এই রিপুর কথাটাকে ভারতবর্ষ সামান্য বলিয়া জ্ঞান করিয়াছিল। যে-সমস্ত ইংরেজ এ দেশে রাজসেরেস্তার আমল বা পণ্যজীবী, তাহারা ভারতবর্ষের অত্যন্ত বেশি নিকটে আছে । এই নিকটের দৃশ্যের মধ্যে তাদেরই প্ৰতাপ, তাদেরই ধন সঞ্চয় সব চেয়ে সমুচ্চ, আর ভারতবর্ষের ত্রিশ কোটি মানুষ তাদের সমস্ত সুখদুঃখ লইয়া ছায়ার মতো অস্পষ্ট অবাস্তব ও স্নান । এই কাছের ওজনে, এই উপস্থিত কালের মাপে ভারতবর্ষের দাবি ইহাদের কাছে তুচ্ছ। তাই যে-কোনো বরলাভের প্রভাবে ভারতবর্ষ কিছুমাত্র আত্মশক্তি লাভ করিবে তাহা ক্ষীণ হইয়া, খণ্ডিত হইয়া, রক্তশূন্য হইয়া আমাদের কাছে পৌঁছিবে অথবা অর্ধপথে অপঘাতমূতৃত্যুতে মরিয়া ভারতভাগ্যের মরুপথকে ব্যর্থ সাধুসংকল্পের কঙ্কালে আকীর্ণ করিবে । এই বাধা দিবার শক্তি যারা বহন করিতেছে অব্যাহত প্ৰতাপের মদের নেশায় তারা মাতোয়ারা, কঠিন স্বােজাত্যভিমানের স্তরসঞ্চিত আবরণে তাহাদের মন ভারতবর্ষের মানুষ-সংস্পর্শ হইতে বিচ্ছিন্ন । ভারতবর্ষ ইহাদের কাছে একটা অতি প্ৰকাণ্ড সরকারি বা সওদাগরি আপিস । এ দিকে ইংলন্ডের যে-ইংরেজ আমাদের ভাগ্যনায়ক তার রক্তের সঙ্গে ইহাদের রক্তের মিল, তার হাতের উপরে ইহাদের হাত, তার কানের কাছে ইহাদের মুখ, তার মন্ত্রণাগৃহে ইহাদের আসন, তার পোলিটিকাল নাট্যশালার নেপথ্যবিধান-গৃহে ইহাদের গতিবিধি । ভারতবর্ষ হইতে নিরন্তর প্রবাহিত হইতে হইতে ইংলন্ডের ইংরেজ-সমাজের পরতে পরতে ইহারা মিশিয়াছে ; সেখানকার ইংরেজের মনস্তত্ত্বকে ইহারা গড়িয়া তুলিতেছে। ইহারা নিজের পককেশের শপথ করে, অভিজ্ঞতার দোহাই পাড়ে এবং “আমরাই ভারতসাম্রাজ্যের শিখরচুড়াকে অপরিমিত উচ্চ করিয়া তুলিয়াছি। এই বলিয়া ইহারা অপরিমিত প্রশ্ৰয় দাবি করে । এই অভ্ৰভেদী অভিমানের ছায়ান্তরালে আমাদের ভাষা, আমাদের আশা, আমাদের অস্তিত্ব কোথায় । ইহাকে উত্তীর্ণ হইয়া, আপিসের প্রাচীর ডিঙাইয়া, ত্ৰিশ কোটি ভারতবাসীকে মানুষ বলিয়া দেখিতে পায় এমন অসাধারণ দৃষ্টিশক্তি কার কাছে প্ৰত্যাশা করিব । যে দূরবতী ইংরেজ যুরোপীয় আবহাওয়ার মধ্যে আছে বলিয়াই অন্ধ স্বার্থের কুহক কাট্রাইয়া ভারতবর্ষকে উদার দৃষ্টিতে দেখিতে পায়, ইহারা তাহাদিগকে জানায় যে, নীচের আকাশের ধুলানিবিড়