পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

कोंक्स ○ 。《。 কথাই নাই, তার স্পৰ্শই সাংঘাতিক । কিছুকাল পূর্বে শান্তিনিকেতনের ছেলেরা বীরভূমের জেলাস্কুলে পরীক্ষা দিতে গেলে পুলিসের লোক আর-কিছুই না করিয়া কেবলমাত্র তাহাদের নাম টুকিয়া লইত । আর বেশি কিছু করিবার দরকার নাই ; উহাদের নিশ্বাস লাগিলেই কঁচা প্ৰাণের অন্ধুর শুকাইতে শুরু করে । উহাদের খাতা যে গুপ্ত খাতা, উহাদের চাল যে গুপ্ত চাল। সাপে-খাওয়া ফল যেমন কেহ খায় না, আজকের দিনে তেমনি পুলিসে-ছোওয়া মানুষকে কেহ কোনো ব্যবহারে লাগায় না । এমন-কি, যে মরিয়া-মানুষকে বৃদ্ধ রুগণ দরিদ্র কুগ্ৰী কুচরিত্র কেহই পিছু হঠাইতে পারে না, বাংলাদেশের সেই কন্যাদায়িক বাপও তার কাছে ঘটক পাঠাইতে ভয় করে । সে দোকান করিতে গেলে তার দোকান চলে না, সে ভিক্ষা চাহিলে তাহাকে দয়া করিতে পারি। কিন্তু দান করিতে বিপদ গনি । দেশের কোনো হিতকর্মে তাহাকে লাগাইলে সে কর্ম নষ্ট হইবে । যে অধ্যক্ষদের পরে এই বিভীষিকা-বিভাগের ভার তারা তো রক্তমাংসের মানুষ ; তারা তো রাগদ্বেষবিবর্জিত মহাপুরুষ নন। রাগ বা আতঙ্কের সময় আমরাও যেমন অল্প প্রমাণেই ছায়াকে বস্তু বলিয়া ঠাহর করি, তারাও ঠিক তাই করেন । সকল মানুষকে সন্দেহ করাটাই যখন তাদের ব্যবসায় হয় তখন সকল মানুষকে অবিশ্বাস করাটাই তাদের স্বভাব হইয়া ওঠে । সংশয়ের সামান্য আভাসমাত্রকেই চূড়ান্ত করিয়া নিরাপদকে পাকা করিতে তাদের স্বভাবতই প্রবৃত্তি হয়- কেননা, উপরে তাদের দায়িত্ব অল্প, চারি পাশের লোক ভয়ে নিস্তান্ধ, আর পিছনে ভারতের ইংরেজ হয়। উদাসীন নয় উৎসাহদাতা । যেখানে স্বাভাবিক দরদ নাই। অথচ ক্ৰোধ আছে এবং শক্তিও অব্যাহত সেখানে কার্যপ্ৰণালী যদি গুপ্ত এবং বিচারপ্রণালী যদি বিমুখ হয় তবে সেই ক্ষেত্রেই যে ন্যায়ধর্মরক্ষিত হইতেছে। এ কথা কি আমাদের ছোটো-ইংরেজও সত্যই বিশ্বাস করেন । আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি, তিনি বিশ্বাস করেন না, কিন্তু তার বিশ্বাস এই যে, কাজ উদ্ধার হইতেছে। কারণ দেখিয়াছি, জার্মানিও এই বিশ্বাসের জোরে ইন্টারন্যাশনাল আইনকে এবং দয়াধর্মকে অগ্ৰাহ্য করিয়া যুদ্ধ জিতিবার নিয়মকে সহজ করিয়াছে। তার কারণ, দুৰ্ভাগ্যক্রমে জার্মানিতে আজ বড়ো-জার্মানের চেয়ে ছোটাে-জার্মানের প্রভাব বড়ো হইয়াছে, যো-জার্মান কাজ করিবার যন্ত্র এবং যুদ্ধ করিবার কায়দামাত্র । আবার বলি, “শির লে আও” বলিতে পারিলে রাজকাৰ্য উদ্ধার হইতে পারে, যে-রাজকাৰ্য উপস্থিতের কিন্তু রাজনীতির অধঃপতন ঘটে, যে-রাজনীতি চিরদিনের । এই রাজনীতির জন্য ইংলন্ডের ইতিহাসে ইংরেজ লড়াই করিয়াছে, এই রাজনীতির ব্যভিচারেই জর্মানির প্রতি মহৎ ঘূণায় উদ্দীপ্ত ইংরেজ যুবক দলে দলে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিতে ছুটিয়াছে। বিশ্বমানবের ইতিহাসকে অখণ্ড করিয়া দেখিবার অধ্যাত্মদৃষ্টি যাহাতে শান্তিনিকেতন-আশ্রমের বালকদের পক্ষে দুর্বল বা কলুষিত না হয় আমি এই লক্ষ্য দৃঢ় করিয়া রাখিয়াছি। তাই এই আশ্রমের শুভকার্যে ইংরেজ সাধকেরও জীবন-উপহার দাবি করিতে আমি কুষ্ঠিত হই নাই। পরমসত্যকে আমি কোনো বড়ো নামের দোহাই দিয়া খণ্ডিত করিতে চাই নাই, ইহাতে আমার ধর্মনীতিকে নিজঝের ইংরেজ ও এ-দেশী শিষ্যগণ দুর্বলের ধর্মনীতি ও মুমূর্ফর সাত্মনা বলিয়া অবজ্ঞা করিতে পারেন। আমাদের অবস্থা অস্বাভাবিক ; আমাদের বর্তমানের ক্ষেত্র ও ভবিষ্যতের আশা চারি দিকে সংকীর্ণ ; আমাদের অন্তর্নিহিত মানসিক শক্তিবিকাশের উৎসাহ ক্ষীণ ও সুযোগ বাধাগ্ৰস্ত ; বড়ো বড়ো উদ্ধতপদমান ও দায়িত্বের নিম্নতলের আওতায় কৃশ ও খর্ব হইয়া আমরা যে-ফল ফলাইয়া থাকি জগতের হাটে তার প্রয়োজন তুচ্ছ, তার দাম যৎকিঞ্চিৎ ; অথচ সেই খর্বতাটাই আমাদের চিরস্বভাব এই অপবাদ দিয়া সেই আওতাটাকে চিরনিবিড় করিয়া রাখা আমাদের মতো গুলেসুর পক্ষে কল্যাণকর বলিয়া দেশে বিদেশে ঘোষণা চলিতেছে । এই অবস্থায় যে-অবসাদ আনে তাহাতে দেশের লোকের মন অন্তরে অন্তরে গুরুভারাক্রান্ত হইয়া উঠে । এই কারণেই ভয়দ্বেষবিবর্জিত আধ্যাত্মিক মুক্তিসাধনের উপদেশ এ দেশে আজকাল শ্রদ্ধা পায় না। তবু আমার বিশ্বাস, এই-সকল বাধার সঙ্গে লড়াই করিয়াও আমাদের আশ্রমের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় নাই। কেননা, বাধা দুরূহ হইলেও পরমার্থের সন্তাটিকে মানুষের সামনে উপস্থিত করিলে সে তাকে একেবারে অশ্রদ্ধা করিতে পারে না- এমন-কি, আমাদের