পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর @ ՆԳ লইয়া কারবার করে না, যারা নিজের বিধান রচিত একটা কৃত্ৰিম জগতে প্ৰভুত্বজাল বিস্তার করে । স্বাধীনদেশে এই বুরোক্রেসি সর্বপ্রধান নয়, এইজন্য মানুষ ইহাদের ফাকের মধ্য দিয়া বাড়িয়া উঠিতে পারে। অধীনদেশে এই বুরোক্রেসি কোথাও একটুও ফাক রাখিতে চায় না। আমরা যখন খোলা আকাশে মাথা তুলিবার জন্য ফাকের দরবার করি, তখন ইহাদের ছোটােবড়ো শাখাপ্রশাখা সমুদ্রের এপারে-ওপারে এমনি প্ৰচণ্ড বেগে আন্দোলিত হইতে থাকে যে, তখন আমরা ব্যতিব্যস্ত হইয়া ভাবিফঁাকে কাজ নাই, এখন ঐ ডালের ঝাপটা খাইয়া ভাঙিয়া না পড়িতে হয়। তবু শেষ কথাটা বলিয়া রাখি ; কোনো অস্বাভাবিকতাকে কেবলমাত্র গায়ের জোরে অত্যন্ত বলবান জাতিও শেষ পর্যন্ত সঙিনের আগায় সিধা। রাখিতে পারে না। ভার বাড়িয়া ওঠে, হাত ক্লান্ত হয় এবং বিশ্বসৃথিবীর বিপুল ভারাকর্ষণ স্বভাবের অসামঞ্জস্যকে ধূলিসাৎ করিয়া দেয়। স্বাভাবিকতাটা কী । না, শাসনপ্রণালী যেমনি হােক আর যারই হোক, দেশের লোকের সঙ্গে দেশের শাসনতন্ত্রের দায়িত্বের যোগ থাকা, দেশের শাসনতন্ত্রের প্রতি দেশের লোকের মমত্ব থাকা । সেই শাসন নিরবচ্ছিন্ন বাহিরের জিনিস হইলে তার প্রতি প্ৰজার ঔদাসীন্য বিতৃষ্ণায় পরিণত হইবেই হইবে। পাকাইয়া তোলেন । এমনি করিয়া সমস্যা কেবলই জটিলতর হইতে থাকে । বর্তমান যুগসত্যের দূত হইয়া ইংরেজ এ-দেশে আসিয়াছেন। যে-কালের যাহা সব চেয়ে বড়ো বিশ্বসম্পদ তাহা নানা আকারে নানা উপায়ে দেশে দেশে ছড়াইয়া পড়িবেই। র্যারা সেই সম্পদের বাহন, তারা যদি লোভের বশ হইয়া কৃপণতা করেন, তবে তারা ধর্মের অভিপ্ৰায়কে অনর্থক বাধা দিয়া দুঃখ সৃষ্টি করিবেন, কিন্তু তারা যে-আগুন বহন করিতেছেন তাকে চাপা দিয়া রাখিতে পরিবেন না। যাহা দিবার তাহা তাহাদিগকে দিতেই হইবে, কেননা এ দানে তাহারা উপলক্ষ, এ দান এখনকার যুগের দান । কিন্তু অস্বাভাবিকতা হইতেছে এই যে, তাদের ঐতিহাসিক শুক্লপক্ষের দিকে তারা যে-সত্যকে বিকীর্ণ করিতেছেন, তাদের ঐতিহাসিক কৃষ্ণপক্ষের দিকে তঁরাই সেই সত্যকে শাসনের অন্ধকারে আচ্ছন্ন করিতেছেন । কিন্তু নিজের প্রকৃতির এক অংশকে তঁরা আর-এক অংশ দিয়া কিছুতেই প্ৰবঞ্চিত করিতে পরিবেন না । বড়ো-ইংরেজকে ছোটো-ইংরেজ চিরদিন স্বার্থের বাধা দিয়া ঠেকাইবার চেষ্টা করিলে দুঃখ-দুৰ্গতি বাড়াইতে থাকিবেন । ঐতিহাসিক খেলায় হাতের কাগজ দেখাইয়া খেলা হয় না । তার পরিণাম সমস্ত হিসাবের বিরুদ্ধে হঠাৎ দেখা দিয়া চমক লাগায় । এইজন্য মোটের উপর এই তত্ত্বটা বলা যায় যে, কোনো অস্বাভাবিকতাকে দীর্ঘকাল প্রশ্ৰয় দিতে দিতে যখন মনে এই বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে আমার তৈরি নিয়মই নিয়ম, তখনই ইতিহাস হঠাৎ একটা সামান্য ঠোকর খাইয়া উলটাইয়া পড়ে। শত বৎসর ধরিয়া মানুষ মানুষের কাছে আছে অথচ তার সঙ্গে মানবসম্বন্ধ নাই ; তাকে শাসন করিতেছে অথচ তাকে কোনোমতেই আত্মীয় করিতেছে না ; পূর্বধরণীর প্রাচীর ভাঙিয়া পশ্চিম একেবারে তার গোলাবাড়ির ভিতর আসিয়া পড়িল অথচ এ মন্ত্ৰ ছাড়িল না। Gr, "never the twain shall meet" ; এতবড়ো অস্বাভাবিকতার দুঃখকর বোঝা বিশ্বে কখনোই অটল হইয়া থাকিতে পারে না । যদি ইহার কোনো স্বাভাবিক প্ৰতিকার না থাকে। তবে একটা ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডির পঞ্চমাঙ্কে ইহার যবনিকা পতন হইবে । ভারতবর্ষে আমাদের দুৰ্গতির যে মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি, তারও তো পালা অনেক যুগ ধরিয়া এমনি করিয়া রচিত হইয়াছিল। আমরাও মানুষকে কাছাকাছি রাখিয়াও দূরে ঠেকাইবার বিস্তারিত আয়োজন করিয়াছি ; যে-অধিকারকে সকলের চেয়ে মূল্যবান বলিয়া নিজে গ্রহণ করিলাম, অন্যকে কেবলই তাহা হইতে বঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছি ; আমরাও স্বধৰ্ম বলিয়া একটা বড়ো নাম দিয়া মানুষের অবমাননা করিয়া নিত্যধর্মকে পীড়িত করিয়াছি। শাস্ত্ৰবিধির অতি কঠিন বঁাধন দিয়াও এই অস্বাভাবিকতাকে, এই অপবিত্র দেবদ্রোহকে আমরা নিজের ইতিহাসের অনুকুল করিয়া তুলিতে পারি নাই। মনে করিয়াছিলাম, আমাদের বল এইখানেই, কিন্তু এইখানেই আমাদের সকলের চেয়ে দুর্বলতা। এইখানেই শতাব্দীর পর শতাব্দী আমরা প্রতি পদে কেবল আপনাকে মারিতে মারিতে মরিয়াছি ।