পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

6 ዒbr রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ক্রমেই নিরতিশয় অবাধ হয়ে আসছে। এই শাসন বৈজ্ঞানিক প্ৰণালীতে এতই আটঘাট-বাধা যে, এর জালে যে-বেচারা পড়েছে। কোথাও কোনোকালে এতটুকু ফাক দিয়ে একটুখানি বেরবার তার আশা নেই। তবুও কিছুতেই আশ মিটছে না, কেননা লোভ যে ভীরু, সে অতিবড়ো শক্তিমানকে নিশ্চিন্ত হতে দেয় না । শক্তিমান তাই বসে বসে এই ঠাওরাচ্ছে যে, শাসনের ইস্কু-কলে এমনি কষে প্যাচ দিতে হবে যে, নালিশ জানাতে মানুষের সাহস হবে না, সাক্ষ্য দিতে ভয় পাবে, ঘরের কোণেও চেচিয়ে কঁদলে অপরাধ হবে । কিন্তু শাসনকে এত বেশি সহজ করে ফেলে যারা সেই শাসনের ভার নিচ্ছে, নিজের মনুষ্যত্বের তহবিল ভেঙে এই অতিসহজ শাসনের মূল্য তাদের জোগাতে হবে। প্রতিদিন এই যে তহবিল ভেঙে চলা এর ফলটা প্ৰতিদিন নানা আকারে নিজের ঘরেই দেখা দেবে । এখনো দেখা দিচ্ছে কিন্তু তার হিসাব কেউ মিলিয়ে দেখছে না । এই তো প্ৰবলপক্ষ সম্বন্ধে বক্তব্য । আমাদের পক্ষে এ-সব কথা বেশি করে আলোচনা করতে বড়ো লজা বোধ হয়, কেননা বাইরে থেকে এর আকারটা উপদেশের মতো, কিন্তু এর ভিতরের চেহারাটা মার খেয়ে কান্নারই রূপান্তর । এক দিকে ভয় আর-এক দিকে কান্না, দুর্বলের এইটেই হচ্ছে সকলের চেয়ে বড়ো লজ্জা । প্রবলের সঙ্গে লড়াই করবার শক্তি আমাদের নেই। কিন্তু নিজের সঙ্গে লড়াই আমাদের করতেই হবে । আর যাই করি, ভয় আমরা করব না, এবং কথা বলা যদি বন্ধ করে দেয়। তবে সমুদ্রের এ-পার থেকে ও-পার পর্যন্ত নাকি সুরে কান্না আমরা তুলিব না। দুঃখের আগুন যখন জ্বলে তখন কেবল তার তাপেই জ্বলে মরব। আর তার আলোটা কোনো কাজেই লাগাব না এটা হলেই সব চেয়ে বড়ো লোকসান। সেই আলোটাতে মোহ-আঁধার ঘুচুক, একবার ভালো করে চেয়ে দেখো । নিজের মনকে একবার জিজ্ঞাসা করো, ঐ বীভৎস শক্তিমান মানুষটাকে যত বড়ো দেখাচ্ছে সে কি সত্যই তত বড়ো । বাইরে থেকে সে ভাঙচুর করতে পারে। কিন্তু ভিতর থেকে মানুষের জীবনের সম্পদ লেশমাত্ৰ যোগ করে দিয়ে যাবার সাধ্য। ওর আছে ? ও সন্ধি করতে পারে। কিন্তু শাস্তি দিতে পারে কি ! ও অভিভূত করতে পারে। কিন্তু শক্তি দান করতে পারে কি । আজ প্ৰায় দু-হাজার বছর আগে সামান্য একদল জাল-জীবীর অখ্যাত এক গুরুকে প্রবল রোম সাম্রাজ্যের একজন শাসনকর্তা চোরের সঙ্গে সমান দণ্ডকাষ্ঠে বিধে মেরেছিল । সেদিন সেই শাসনকর্তার ভোজের অন্নে কোনো ব্যঞ্জনের ত্রুটি হয় নি এবং সে আপন রাজপালঙ্কে আরামেই ঘুমাতে গিয়েছিল । সেদিন বাইরে থেকে বড়ো দেখিয়েছিল কাকে । আর আজ ? সেদিন সেই মশানে বেদন এবং মৃত্যু এবং ভয়, আর রাজপ্রাসাদে ভোগ এবং সমারোহ । আর আজ ? আমরা কার কাছে মাথা নত করব । কস্মৈ দেবায় হবিদ্যা বিধেম । 8 বাংলার মঙ্গলকাব্যগুলির বিষয়টা হচ্ছে, এক দেবতাকে তার সিংহাসন থেকে খেদিয়ে দিয়ে আর-এক দেবতার অভু্যদয় । সহজেই এই কথা মনে হয় যে, দুই-দেবতার মধ্যে যদি কিছু নিয়ে প্রতিযোগিতা থাকে তা হলে সেটা ধর্মনীতিগত আদর্শেরই তারতম্য নিয়ে। যদি মানুষের ধর্মবুদ্ধিকে নূতন দেবতা পুরাতন দেবতার চেয়ে বেশি তৃপ্তি দিতে পারেন তা হলেই তাকে বরণ করবার সংগত কারণ পাওয়া যায় । কিন্তু এখানে দেখি একেবারেই উলটাে । এককালে পুরুষদেবতা যিনি ছিলেন তার বিশেষ কোনো উপদ্রব ছিল না। খামকা মেয়েদেবতা জোর করে এসে বায়না ধরলেন, আমার পুজো চাই। অর্থাৎ যো-জায়গায় আমার দখল নেই, সে-জায়গা আমি দখল করবই। তোমার দলিল কী । গায়ের জোর । কী উপায়ে দখল করবে। যে উপায়েই হােক। তার পরে যে-সকল উপায় দেখা গেল মানুষের সদবুদ্ধিতে তাকে সদুপায় বলে না । কিন্তু পরিণামে এই সকল উপায়েরই জয় হল । ছলনা, অন্যায় এবং নিষ্ঠুরতা কেবল যে মন্দির দখল করল তা নয়, কবিদের দিয়ে মন্দিরা বাজিয়ে চামর দুলিয়ে