পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(ሱbrO রবীন্দ্র-রচনাবলী এই সামান্য ব্যাধ যখন লড়াই করল, তখন খামক স্বয়ং হনুমান এসে তার পক্ষ নিয়ে কলিঙ্গের সৈন্যকে কিলিয়ে লাথিয়ে একাকার করে দিলে। একেই বলে শক্তির স্বপ্ন, ক্ষুধা এবং ভয়ের বরপুত্র । হঠাৎ একটা কিছু হবে । তাই সেই অতি-অদ্ভুত হঠাতের আশায় আমরা দলে দলে উচ্চৈঃস্বরে মা মা করে চণ্ডীগান করতে লেগে গেছি। সেই চণ্ডী ন্যায় অন্যায় মানে না, সুবিধার খাতিরে সত্যমিথ্যায়। সে ভেদ করে না, সে যেন-তেন প্রকারে ছোটোকে বড়ো, দরিদ্রকে ধনী, অশক্তকে শক্তিমান করে দেয় । তার জন্য যোগ্য হবার দরকার নেই, অন্তরের দারিদ্র্য দূর করবার প্রয়োজন হবে না, যেখানে যা যেমনভাবে আছে আলস্যভরে সেখানে তাকে তেমনি ভাবেই রাখা চলবে । কেবল করজোড়ে তারস্বরে বলতে হবে- মা মা মা ! যখন মোগল পাঠানের বন্যা দেশের উপর ভেঙে পড়ল, তখন সংসারের যে-বাহারাপ মানুষ প্রবল করে দেখতে পেলে সেটা শক্তিরই রূপ । সেখানে ধর্মের হিসাব পাওয়া যায় না, সেখানে শিবের পরিচয় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। মানুষ যদি তখনো সমস্ত দুঃখ এবং পরাভাবের মাঝখানে দাড়িয়ে বলতে পারে, আমি সব সহ্য করব। তবুও কিছুতেই একে দেবতা বলে মানতে পারব না, তা হলেই মানুষের জিত হয় । চাঁদ সদাগর কিংবা ধনপতির বিদ্রোহের মধ্যে কিছুদূর পর্যন্ত মানুষের সেই পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল। মারের পর মার খেয়েছে কিন্তু ভক্তিকে ঠিক জায়গা থেকে নড়তে দেয় নি । মিথ্যা এবং অন্যায় চার দিক থেকে তাদের আক্রমণ করলে ; চণ্ডী বললেন, ভয়ে অভিভূত করে, দুঃখে জর্জর করে, ক্ষতিতে দুর্বল করে, মারের চোটে মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে তোমাদের কাছ থেকে জোর করে আমার পূজা আদায় করবই। নইলে ? নইলে আমার প্রেস্টিজ যায়। ধর্মের প্রেস্টিজের জন্যে চণ্ডীর খেয়াল নেই, তার প্রেস্টিজ হচ্ছে ক্ষমতার প্রেস্টিজ । অতএব মারের পর মার, মারের পর মার ! অবশেষে দুঃখের যখন চূড়ান্ত হল, তখন শিবকে সরিয়ে রেখে শক্তির কাছে আধমরা সদাগর মাথা হেঁট করলে । শক্তি তাদের এতদিন যে এত দুঃখ দিয়েছিল সে দুঃখে তেমন অপমান নেই। যেমন অপমান শেষকালে এই মাথা হেঁট করে । যে-আত্মা অভয়, যে-আত্মা অমর, সে আপন প্ৰতিষ্ঠা থেকে নেমে এসে ভয়কে মৃত্যুকে দেবতা বলে, আপনার চেয়ে বড়ো বলে মানলে । এইখানেই শক্তির সকলের চেয়ে বীভৎস পরিচয় পাওয়া গেল । আমরা আজ য়ুরোপের দেবতাকে স্বপ্নে পূজো করতে বসেছি, এইটোতেই য়ুরোপের কাছে আমাদের সব চেয়ে পরাভব হয়েছে। যদি সে আমাদের আঘাত করতে চায় করুক, আমরা সহ্য করব, কিন্তু তাই বলে পুজো করব ? সে চলবে না ; কেননা পুজো করতে হবে ধর্মরাজকে । সে দুঃখ দেবে, দিক গে । কিন্তু হারিয়ে দেবে ? কিছুতে না । মরার বাড়া গাল নেই ; কিন্তু মরেও অমর হওয়া যায় এই কথা যদি কিছুতে ভুলিয়ে দেয় তা হলে তার চেয়ে সর্বনেশে মৃত্যু আর নেই। মহান্তং বিভুম আত্মানং মত্বা ধীরো ন শোচতি । (* মানুষের ইতিহাসের রথ আজ যত বড়ো ধাক্কা খেয়েছে এমন আর কোনোদিনই খায় নি। তার কারণ আধুনিক ইতিহাসের রথটা কলের গাড়ি, বহু কৌশলে ওর লোহার রাস্তা বাধা, আর এক-একটা এঞ্জিনের পিছনে গাড়ির শ্রেণী প্ৰকাণ্ড লম্বা হয়ে বাধা পড়েছে। তার পরে ওর পথ চলেছে জগৎ জুড়ে, নানা জায়গায় নানা পথে কাটাকাটি । কাজেই কলে কলে যদি একবার সংঘাত বাধল, যদি পরস্পরকে বঁচিয়ে চলতে না পারল, তা হলে সেই দুর্যোগে ভাঙচুরের পরিমাণ অতি ভয়ানক হয়ে ওঠে, এবং পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আর-এক প্ৰান্ত পর্যন্ত থারথার করে কঁাপিতে থাকে । এই কলের গাড়ির সংঘাত এবারে খুব প্ৰবল ধাক্কায় ঘটেছে, কী মাল কী সওয়ারী নাস্তানাবুদ হয়ে গেল । তাই চারি দিকে প্রশ্ন উঠেছে, এ কী হল, কেমন করে হল, কী করলে ভবিষ্যতে এমন আর না হতে পারে ।