পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Gtbr Sq রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী সর্বতোভাবে আপত্তি করবার জোর আমাদের কোথায় । জোর করি সেই বিদেশীরই ধর্মবুদ্ধির দোহাই দিয়ে । সে দোহাইয়ে কি লজ্জা বেড়ে ওঠে না। এ কথা বলতে কি মাথা হেঁট হয়ে যায় না যে, সমাজে আমাদের আদর্শকে আমরা ছোটো করে রাখব, আর পলিটিক্সে তোমাদের আদর্শকে তোমরা উচু করে রাখোঁ ? আমরা দাসত্বের সমস্ত বিধি সমাজের মধ্যে বিচিত্র আকারে প্রবল করে রাখব। আর তোমরা তোমাদের ঔদার্যের দ্বারা প্ৰভুত্বের সমান অধিকার আমাদের হাতে নিজে তুলে দেবে ? যেখানে আমাদের এলেকা সেখানে ধর্মের নামে আমরা অতি কঠোর কৃপণতা করব, কিন্তু যেখানে তোমাদের এলেকা সেখানে সেই ধর্মের দোহাই দিয়ে অপৰ্যাপ্ত বদ্যান্যতার জন্যে তোমাদের কাছে দরবার করতে থাকব। এমন কথা বলি কোন মুখে । আর যদি আমাদের দরবার মঞ্জর হয় ? যদি আমরা আমাদের দেশের লোককে প্রত্যহ অপমান করতে কুষ্ঠিত না হই, অথচ বিদেশের লোক এসে আপনি ধর্মবুদ্ধিতে সেই অপমানিতদের সম্মানিত করে তা হলে ভিতরে বাহিরেই কি আমাদের পরাভব সম্পূর্ণ হয় না। আজকের দিনে যে কারণে হােক দুঃখ এবং অপমানের বেদনা নিরতিশয় প্রবল হয়ে উঠেছে ; এই উপলক্ষে আমাদের মনে একটা কথা আশা করবার আছে, সেটা হচ্ছে এই যে, ধর্মবুদ্ধিতে যখন অন্যপক্ষের পরাভব হচ্ছে তখন সেইখানে আমরা এদের উপরে উঠাব । তা হলে এদের হাতের আঘাতে আমাদের গৌরব হানি করবে না। বরং বাড়াবে । কিন্তু সেখানেও কি আমরা বলব ধর্মবুদ্ধিতে তোমরা আমাদের চেয়ে বড়ো হয়ে থাকো ; নিজেদের সম্বন্ধে আমরা যে-রকম ব্যবহার করবার আশা করি। নে আমাদের সম্বন্ধে তোমরা সেই রকম ব্যবহারই করো ? অর্থাৎ চিরদিনই নিজের ব্যবস্থায় আমরা নিজেদের খাটো করে রাখি, আর চিরদিনই তোমরা নিজগুণে আমাদের বড়ো করে তোলো । সমস্ত বরাতই অন্যের উপরে, আর নিজের উপরে একটুও নয় ? এত অশ্রদ্ধা নিজেকে, আর এতই শ্রদ্ধা অন্যকে ? বাহুবলগত অধমতার চেয়ে এই ধর্মবুদ্ধিগত অধমতা কি আরো বেশি নিকৃষ্ট নয় । অল্পকাল হল একটা আলোচনা আমি স্বকৰ্ণে শুনেছি, তার সিদ্ধান্ত এই যে, পরস্পরের মধ্যে পাকা দেওয়ালের ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও এক চালের নীচে হিন্দু-মুসলমান আহার করতে পারবে না, এমন-কি, সেই আহারে হিন্দু-মুসলমানের নিষিদ্ধ কোনো আহার্য যদি নাও থাকে। র্যারা এ কথা বলতে কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করেন না, হিন্দুমুসলমানের বিরোধের সময় তারাই সন্দেহ করেন যে বিদেশী কর্তৃপক্ষেরা এই বিরোধ ঘটাবার মূলে । এই সন্দেহ যখন করেন তখন ধর্মবিচারে তারা বিদেশীকে দণ্ডনীয় মনে করেন । এর একমাত্র কারণ ধর্মের দাবি নিজের উপরে তাদের যতটা, বিদেশীর উপরে তার চেয়ে অনেক বেশি। স্বদেশে মানুষে মানুষে ব্যবধানকে আমরা দুঃসহরাপে পাকা করে রাখব সেইটেই ধর্ম, কিন্তু বিদেশী সেই ব্যবধানকে কোনো কারণেই কোনোমতেই নিজের ব্যবহারে লাগালে সেটা অধৰ্ম। আত্মপক্ষে দুর্বলতাকে সৃষ্টি করব ধর্মের নামে, বিরুদ্ধপক্ষে সেই দুর্বলতাকে ব্যবহার করলেই সেটাকে অন্যায় বলব । যদি জিজ্ঞাসা করা যায়, পাকা দেওয়ালের অপর পারে যেখানে মুসলমান খাচ্ছে দেওয়ালের এপারে। সেখানে হিন্দু কেন খেতে পারে না, তা হলে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়াই আবশ্যক হবে না । হিন্দুর পক্ষে এ প্রশ্নে বুদ্ধি খাটানাে নিষেধ এবং সেই নিষেধটা বুদ্ধিমান জীবের পক্ষে কত অদ্ভুত ও লজ্জাকর তা মনে উদয় হবার শক্তি পর্যন্ত চলে গেছে । সমাজের বিধানে নিজের বারো-আনা ব্যবহারের কোনোপ্রকার সংগত কারণ নির্দেশ করতে আমরা বাধ্য নই ; যেমন বাধ্য নয়। গাছপালা কীটপতঙ্গ পশুপক্ষী । পলিটিক্সে বিদেশীর সঙ্গে কারবারে আমরা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে শিখেছি- সে ক্ষেত্রে সকল রকম বিধিবিধানের একটা বুদ্ধিগত জবাবদিহি আছে বলে মানতে অভ্যাস করছি ; কিন্তু সমাজে পরস্পরের সঙ্গে ব্যবহার, যার উপরে পরস্পরের গুরুতর সুখদুঃখ শুভাশুভ প্রত্যহ নির্ভর করে সে সম্বন্ধে বুদ্ধির কোনো কৈফিয়ত নেওয়া চলে এ কথা আমরা ভাবতেও একেবারে ভুলে গেছি। এমনি করে যে-দেশে ধর্মবুদ্ধিতে এবং কর্মবুদ্ধিতে মানুষ নিজেকে দাসানুদাস করে রেখেছে, সে-দেশে কর্তৃত্বের অধিকার চাইবার সত্যকার জোর মানুষের নিজের মধ্যে থাকতেই পারে না ।