পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর G&S প্রেমের ডাকে ভারতবর্ষের হৃদয়ের এই-যে আশ্চর্য উদবোধন, এর কিছু সুর সমুদ্রপারে আমার কানে গিয়ে পৌঁচেছিল । তখন বড়ো আনন্দে এই কথা আমার মনে হয়েছিল, যে, এইবার এই উদবােধনের দরবারে আমাদের সকলেরই ডাক পড়বে, ভারতবাসীর চিত্তে শক্তির যে বিচিত্র রূপ প্রচ্ছন্ন আছে সমস্তই প্রকাশিত হবে । কারণ, আমি একেই আমার দেশের মুক্তি বলি- প্ৰকাশই হচ্ছে মুক্তি। ভারতবর্ষে একদিন বুদ্ধদেব সর্বভূতের প্রতি মৈশ্ৰীমন্ত্র নিজের সত্যসাধনার ভিতর দিয়ে প্রকাশ করেছিলেন ; তার ফল হয়েছিল। এই যে, সেই সত্যের প্রেরণায় ভারতের মনুষ্যত্ব শিল্পকলায় বিজ্ঞানে ঐশ্বর্ষে পরিব্যক্ত হয়ে উঠেছিল। রাষ্ট্রশাসনের দিক থেকে সেদিনও ভারত বারে বারে এক হবার ক্ষণিক প্ৰয়াসের পর বারে বারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তার চিত্ত সুপ্তি থেকে-অপ্ৰকাশ থেকে মুক্তিলাভ করেছিল। এই মুক্তির জোর এত যে, সে আপনাকে দেশের কোনো ক্ষুদ্র সীমায় বদ্ধ করে রাখতে পারে নি— সমুদ্রমরুপারেও যে দূরদেশকে সে স্পর্শ করেছে তারই চিত্তের ঐশ্বৰ্যকে উদঘাটন করেছে। আজকের দিনে কোনো বণিক কোনো সৈনিক এ কাজ করতে পারে নি ; তারা পৃথিবীকে যেখানেই স্পর্শ করেছে সেইখানেই বিরোধ পীড়া এবং অপমান জাগিয়েছে, সেইখানেই বিশ্বপ্রকৃতির শ্ৰী নষ্ট করে দিয়েছে । কেন । কেননা, লোভ সত্য নয়, প্রেমই সত্য । এইজন্য প্রেম যখন মুক্তি দেয়। সে একেবারে ভিতরের দিক থেকে । কিন্তু লোভা যখন স্বাতন্ত্র্যের জন্যে চেষ্টা করে তখন সে জবৰ্দস্তির দ্বারা নিজের উদ্দেশ্য সাধন করতে অস্থির হয়ে ওঠে । বঙ্গবিভাগের দিনে এইটে আমরা লক্ষ্য করেছি- সেদিন গরিবদের আমরা ত্যাগদূঃখ স্বীকার করতে বাধ্য করেছি। প্রেমের দ্বারা নয়, বাইরে থেকে নানাপ্রকারে চাপ দিয়ে । তার কারণ, লোভ অল্প সময়ের মধ্যে একটা বিশেষ সংকীর্ণ ফললাভের চেষ্টা করে ; প্রেমের যে ফল সে একদিনের নয়, অল্পদিনের জন্যও নয়, সে ফলের সার্থকতা আপনার মধ্যেই । এতদিন পরে আমার দেশে সেই আনন্দময় মুক্তির হাওয়া বইছে। এইটেই আমি কল্পনা করে এসেছিলুম। এসে একটা জিনিস দেখে আমি হতাশ হয়েছি। দেখছি, দেশের মনের উপর বিষম একটা চাপ । বাইরে থেকে কিসের একটা তাড়নায় সবাইকে এক কথা বলতে এক কাজ করাতে ভয়ংকর তাগিদ দিয়েছে । আমি যখন প্রশ্ন করতে যাই, বিচার করতে যাই, আমার হিতৈষীরা ব্যাকুল হয়ে আমার মুখ চাপা। দিয়ে বলেন, আজ তুমি কিছু বোলো না । দেশের হাওয়ায় আজ প্রবল একটা উৎপীড়ন আছে- সে লাঠি-সড়কির উৎপীড়ন নয়, তার চেয়ে ভয়ংকর সে অলক্ষ্য উৎপীড়ন । বর্তমান প্ৰচেষ্টা সম্বন্ধে যাদের মনে কিছুমাত্র সংশয় আছে, তারা সেই সংশয় অতি ভয়ে ভয়ে, অতি সাবধানে প্ৰকাশ করলেও পরমুহুর্তেই তার বিরুদ্ধে একটা শাসন ভিতরে ভিতরে উদ্যত হয়ে ওঠে। কোনো একটি খবরের কাগজে একদিন কাপড় পোড়ানো সম্বন্ধে অতি মৃদুমন্দ মধুর কণ্ঠে একটুখানি আপত্তির আভাসমাত্র প্রকাশ পেয়েছিল ; সম্পাদক বলেন, তার পরদিনই পাঠকমণ্ডলীর চাঞ্চল্য তাকে চঞ্চল করে তুললে । যে আগুনে কাপড় পুড়েছে সেই আগুনে তার কাগজ পুড়তে কতক্ষণ । দেখতে পাচ্ছি এক পক্ষের লোক অত্যন্ত ব্যস্ত, আর-এক পক্ষের লোক অত্যন্ত ত্ৰস্ত । কথা উঠেছে সমস্ত দেশের বুদ্ধিকে চাপা দিতে হবে, বিদ্যাকেও । কেবল বাধ্যতাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে । কার কাছে বাধ্যতা । মন্ত্রের কাছে, অন্ধবিশ্বাসের কাছে । কেন বাধ্যতা । আবার সেই রিপুর কথা এসে পড়ে, সেই লোভ। অতি সত্বর অতি দুর্লভ ধন অতি সস্তায় পাবার একটা আশ্বাস দেশের সামনে জাগছে। এ যেন সন্ন্যাসীর মন্ত্রশক্তিতে সোনা ফলাবার আশ্বাস । এই আশ্বাসের প্রলোভনে মানুষ নিজের বিচারবুদ্ধি অনায়াসে জলাঞ্জলি দিতে পারে এবং অন্য যারা জলাঞ্জলি দিতে রাজি হয় না। তাদের পরে বিষম ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে । বাহিরের স্বাতন্ত্র্যের নামে মানুষের অন্তরের স্বাতন্ত্র্যাকে এইরূপে বিলুপ্ত করা সহজ হয় । সকলের চেয়ে আক্ষেপের বিষয় এই যে সকলেই যে এই আশ্বাসে সম্পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করে তা নয়, কিন্তু তারা বলে, এই প্রলোভনে দেশের একদল লোককে দিয়ে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য সাধন করিয়ে নেওয়া যেতে পারে । “সত্যমেব জয়তে