পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর (SV) এই কাঠির গায়ে একটা তার বেঁধে ঝংকার দাও ; তা হলে অমুক মাসের অমুক তারিখে এই কাঠিই বীণা হয়ে বাজতে থাকবে”, তবে সে কথা খাটবে না । আসলে আমার গুরুর উচিত নয়। আমার অক্ষমতার প্রতি দয়া করা । এ কথা তার বলাই চাই, “এ-সব জিনিস সংক্ষেপে এবং সস্তায় সারা যায় না।” তিনিই তো আমাদের স্পষ্ট বুঝিয়ে দেবেন যে, বীণার একটি মাত্র তার নয়, এর উপকরণ বিস্তর, এর রচনাবলী সূক্ষ্ম, নিয়মে একটুমাত্র ত্রুটি হলে বেসুর বাজবে, অতএব জ্ঞানের তত্ত্বকে ও নিয়মকে বিচারপূর্বক সযত্নে পালন করতে হবে । দেশের হৃদয়ের গভীরতা থেকে সাড়া বের করা এই হল ওস্তান্দজির বীণা বাজানো- এই বিদ্যায় প্ৰেম যে কত বড়ো সত্য জিনিস সেই কথাটা আমরা মহাত্মাজির কাছ থেকে বিশুদ্ধ করে শিখে নিতে বসেছি, এ সম্বন্ধে তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা অক্ষুন্ন থােক। কিন্তু স্বরাজ গড়ে তোলবার তত্ত্ব বহুবিস্তৃত, তার প্রণালী দুঃসাধ্য এবং কালীসাধ্য ; তাতে যেমন আকাঙক্ষা এবং হৃদয়াবেগ তেমনি তথ্যানুসন্ধান এবং বিচারবুদ্ধি চাই। তাতে যারা অর্থশাস্ত্ৰবিৎ তাদের ভাবতে হবে, যন্ত্রতত্ত্ববিৎ তাদের খাটতে হবে, শিক্ষাতত্ত্ববিৎ রাষ্ট্রতত্ত্ববিৎ সকলকেই ধ্যানে এবং কর্মে লগতে হবে। অর্থাৎ দেশের অন্তঃকরণকে সকল দিক থেকে পূর্ণ উদ্যমে জগতে হবে । তাতে দেশের লোকের জিজ্ঞাসাবৃত্তি যেন সর্বদা নির্মল ও নিরভিভূত থাকে, কোনো গৃঢ় বা প্রকাশ্য শাসনের দ্বারা সকলের বুদ্ধিকে যেন ভীরু এবং নিশ্চেষ্ট করে তোলা না হয় । এই যে দেশের বিচিত্র শক্তিকে তলব দেওয়া এবং তাকে নিজের নিজের কাজে লাগানো, এ পারে কে । সকল ডাকে তো দেশ সাড়া দেয় না, পূর্বে তো বারংবার তার পরীক্ষা হয়ে গেছে। দেশের সকল শক্তিকে দেশের সৃষ্টিকার্যে আজ পর্যন্ত কেউ যোগযুক্ত করতে পারে নি বলেই তো এতদিন আমাদের সময় বয়ে গেল। তাই এতকাল অপেক্ষা করে আছি, দেশের লোককে ডাক দেবার র্যার সত্য অধিকার আছে তিনিই সকলকে সকলের আত্মশক্তিতে নিযুক্ত করে দেবেন। একদিন ভারতের তপোবনে আমাদের দীক্ষাগুরু তীর সত্যজ্ঞানের অধিকারে দেশের সমস্ত ব্ৰহ্মচারীদের ডেকে বলেছিলেন যথাপঃ প্রবতায়ন্তি যথা মাসা অহর্জরম। এবং মাং ব্ৰহ্মচারিণো ধাতরায়ন্ত সৰ্ব্বতঃ স্বাহা । জলসকল যেমন নিম্নদেশে গমন করে, মাসসকল যেমন সংবৎসরের দিকে ধাবিত হয়, তেমনি সকল দিক থেকে ব্ৰহ্মচারিগণ আমার নিকটে আসুন, স্বাহা । সেদিনকার সেই সত্যদীিক্ষার ফল আজও জগতে অমর হয়ে আছে এবং তার আহবান এখনো বিশ্বের কানে বাজে । আজ আমাদের কর্মগুরু তেমনি করেই দেশের সমস্ত কর্মশক্তিকে কেন আহবান করবেন না, কেন বলবেন না, আয়ত্ত্ব সর্বতঃ স্বাহা- তারা সকল দিক থেকে আসুক। দেশের সকল শক্তির জাগরণেই দেশের জাগরণ, এবং সেই সর্বতোভাবে জাগরণেই মুক্তি । মহাত্মাজির কণ্ঠে বিধাতা ডাকবার শক্তি দিয়েছেন, কেননা তার মধ্যে সত্য আছে, অতএব এই তো ছিল আমাদের শুভ অবসর । কিন্তু তিনি ডাক দিলেন একটিমাত্র সংকীর্ণ ক্ষেত্রে । তিনি বললেন, কেবলমাত্ৰ সকলে মিলে সুতো কাটাে, কাপড় বোনো । এই ডাক কি সেই “আয়ন্ত সর্বতঃ স্বাহা” । এই ডাক কি নবযুগের মহাসৃষ্টির ডাক । বিশ্বপ্রকৃতি যখন মৌমাছিকে মৌচাকের সংকীর্ণ জীবনযাত্রায় ডাক দিলেন তখন লক্ষ লক্ষ মৌমাছি সেই আহবানে কর্মের সুবিধার জন্য নিজেকে ক্লাব করে দিলে ; আপনাকে খর্ব করার দ্বারা এই-যে তাদের আত্মত্যাগ। এতে তারা মুক্তির উলটাে পথে গেল। যে দেশের অধিকাংশ লোক কোনো প্রলোভনে বা অনুশাসনে অন্ধভাবে নিজের শক্তির ক্লীবত্ব সাধন করতে কুষ্ঠিত হয় না, তাদের বন্দিদশা যে তাদের নিজের অন্তরের মধ্যেই। চরকা কাটা এক দিকে অত্যন্তু সহজ, সেইজন্যে সকল মানুষের পক্ষে তা শক্ত। সহজের ডাক মানুষের নয়, সহজের ডাক মৌমাছির । মানুষের কাছে তা চূড়ান্ত শক্তির দাবি করলে তবেই সে আত্ম-প্রকাশের ঐশ্বৰ্য উদঘাটিত করতে পারে। স্পার্ট বিশেষ লক্ষ্যের দিকে তাকিয়ে মানুষের শক্তিকে সংকীর্ণ করে তাকে বল দেবার চেষ্টা করেছিল, স্পার্টার জয় হয় নি ; এথেন্স মানুষের সকল শক্তিকে উন্মুক্ত করে তাকে পূর্ণতা দিতে চেয়েছিল, এথেন্সের জয় হয়েছে ; তার সেই জয়পতাকা আজও মানবসভ্যতার শিখরচুড়ায় উড়ছে। য়ুরোপে সৈনিকাবাসে কারখানাঘরে মানবশক্তির ক্লীবত্বসাধন