পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর @ ՏԳ সংসাত্ত ছিলুম, তখন আমরা কেবলই পরের অপরাধের তালিকা আউড়ে পরকে তার কর্তব্যক্ৰটি স্মরণ করিয়েছি- আজ যখন আমরা পরপরায়ণতা থেকে আমাদের পলিটিক্সকে ছিন্ন করতে চাই, আজও সেই পরের অপরাধ জপের দ্বারাই আমাদের বর্জননীতির পোষণপালন করতে চাচ্ছি। তাতে উত্তরোত্তর আমাদের যে মনোভাব প্রবল হয়ে উঠছে সে আমাদের চিত্তের আকাশে রক্তবর্ণ ধুলো উড়িয়ে বৃহৎ জগৎ থেকে আমাদের চিন্তাকে আবৃত করে রাখছে। প্রবৃত্তির দ্রুত চরিতার্থতার দিকে আমাদের উত্তেজনা সে কেবলই বাড়িয়ে তুলছে । সমস্ত বিশ্বের সঙ্গে যোগযুক্ত ভারতের বিরাট রূপ চোখে না পড়াতে আমাদের কর্মে ও চিন্তায় ভারতের যে পরিচয় আমরা দিতে প্ৰবৃত্ত হয়েছি সে অতি ছোটাে, তার দীপ্তি নেই ; সে আমাদের ব্যবসায় বুদ্ধিকেই প্রধান করে তুলছে। এই বুদ্ধি কখনো কোনো বড়ো জিনিসকে সৃষ্টি করে নি। আজ পশ্চিম দেশে এই ব্যবসায় বুদ্ধিকে অতিক্রম করে শুভবুদ্ধি জাগিয়ে তোলবার জন্যে একটা আকাঙক্ষা এবং উদ্যম দেখা দিয়েছে । সেখানে কত লোক দেখেছি যারা এই সংকল্পকে মনের মধ্যে নিয়ে আজ সন্ন্যাসী । অর্থাৎ যারা স্বাজাত্যের বঁাধন কেটে ঐক্যের সাধনায় ঘরছাড়া হয়ে বেরিয়েছে, যারা নিজের অন্তরে মানুষের ভিতরকার অদ্বৈতাকে দেখেছে । সেই-সব সন্ন্যাসীকে ইংরেজের মধ্যে অনেক দেখেছি ; তারা তাদের স্বজাতির আত্মম্ভরিতা থেকে দুর্বলকে রক্ষা করবার সাধনায় স্বজাতির কাছ থেকে আঘাত ও অপমান স্বীকার করতে কুষ্ঠিত হন নি । সেইরকম সন্ন্যাসী দেখেছি ফ্রান্সে, যেমন রোম্য রইেলা- তিনি তার দেশের লোকের দ্বারা বর্জিত । সেইরকম সন্ন্যাসী আমি যুরোপের অপেক্ষাকৃত অখ্যাত দেশের প্রান্তে দেখেছি। দেখেছি য়ুরোপের কত ছাত্রের মধ্যে ; সর্বমানবের ঐক্যসাধনায় তাদের মুখচ্ছবি দীপ্যমান । তারা ভাবী যুগের মহিমায় বর্তমান যুগের সমস্ত আঘাত ধৈর্যের সঙ্গে বহন করতে চায়, সমস্ত অপমান বীর্যের সঙ্গে ক্ষমা করতে চায় । আর আমরাই কি কেবল যেমন “পঞ্চকন্যাং স্মরেন্নিত্যং” তেমনি করে আজ এই শুভদিনের প্ৰভাতে কেবল পরের অপরাধ স্মরণ করব, এবং আমাদের জাতীয় সৃষ্টিকার্য একটা কলহের উপর প্রতিষ্ঠিত করতে থাকিব । আমরা কি এই প্রভাবে সেই শুভবুদ্ধিদাতাকে স্মরণ করব না- যা একঃ, যিনি এক ; অবৰ্ণঃ, যিনি বর্ণহীন, র্যার মধ্যে সাদা কালো নেই ; বহুধাশক্তিযোগাৎ বর্ণাননেকান নিহিতার্থে দ ধাতি, যিনি বহুধাশক্তির যোগে অনেক বর্ণের লোকের জন্য তাদের অন্তনিহিত প্রয়োজন বিধান করেছেন ; আর তারই কাছে কি প্রার্থনা করব না, স নাে বুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুনতু, তিনি আমাদের সকলকে শুভবুদ্ধি দ্বারা সংযুক্ত করুন ! কার্তিক ১৩২৮ সমস্যা যে ছাত্রেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসে, তাদের সংখ্যা দশ-বিশ হাজার হয়ে থাকে, কিন্তু তাদের সকলেরই পক্ষে একই প্রশ্ন, এক কালিতে একই অক্ষরে ছাপানো । সেই একই প্রশ্নের একই সত্য উত্তর দিতে পারলে তবে ছাত্রেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তীর্ণ হয়ে পদবী পায় । এইজন্যে পাশ্ববতী পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে উত্তর চুরি করেও কাজ চলে। কিন্তু বিধাতার পরীক্ষার নিয়ম এত সহজ নয় । এক-এক জাতির কাছে তিনি এক-একটি স্বতন্ত্র সমস্যা পাঠিয়েছেন । সেই সমস্যার সত্য মীমাংসা তারা নিজে উদ্ভাবন করলে তবেই তারা তার বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থান পাবে ও মান পাবে । ভারতকেও তিনি একটি বিশেষ সমস্যা দিয়েছেন, যতদিন না তার সত্য মীমাংসা হবে ততদিন ভারতের দুঃখ কিছুতেই শান্ত হবে না । আমরা চাতুরী খাটিয়ে যুরোপের পরীক্ষাপত্র থেকে উত্তর চুরি করছি। একদিন বোকার মতো করছিলুম মাছি-মারা নকল, আজকে বুদ্ধিমানের মতো করছি। ভাষার কিছু বদল ঘটিয়ে । পরীক্ষক বারে বারে তার পাশে নীল পেনসিল দিয়ে যে গোল গোল চিহ্ন কাটছেন তার সাব-কটাকেও একত্ৰ যোগ করতে গেলে বিয়োগান্ত হয়ে ওঠে ।