পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Gobr রবীন্দ্র-রচনাবলী বায়ুমণ্ডলে ঝড় জিনিসটাকে আমরা দুৰ্যোগ বলেই জানি । সে যেন রাগী আকাশটার কিল চড় লাথি ঘুষের আকারে আসতে থাকে। এই প্রহারটা তো হল একটা লক্ষণ। কিসের লক্ষণ । আসল কথা, যে বায়ুস্তরগুলো পাশাপাশি আছে, যে প্রতিবেশীদের মধ্যে মিল থাকা উচিত ছিল, তাদের মধ্যে ভেদ ঘটেছে। এক অংশের বড়ো বেশি গৌরব, আর-এক অংশের বড়ো বেশি লাঘব হয়েছে। এ তো সহ্য হয় না, তাই ইন্দ্ৰদেবের বাজ গড়গড় করে ওঠে, পবনদেবের ভেঁপু হু-হু করে হুংকার দিতে থাকে। যতক্ষণ প্রতিবেশীদের মধ্যে সাম্যসাধন না হয়, হাওয়ায় হাওয়ায় পঙক্তিভেদ ঘুচে না যায়, ততক্ষণ শান্তি হয় না, ততক্ষণ দেবতার রাগ মেটে না । যাদের মধ্যে পরস্পর মিলে চলাবার সম্বন্ধ তাদের মধ্যে ভেদ ঘটলেই তুমুল কাণ্ড বেধে যায়। তখন ঐ-যে অরণ্যটার গভীৰ্য নষ্ট হয়ে যায়, ঐ-যে সমুদ্রটা পাগলামি করতে থাকে, তাদের দোষ দিয়ে বা তাদের কাছে শান্তিশতক আউড়িয়ে কোনো ফল নেই। কান পেতে শুনে নাও, স্বৰ্গে মর্তে এই রব উঠল, “ভেদ ঘটেছে, ভেদ ঘটেছে।” এই হাওয়ার মধ্যে যে কথা, মানুষের মধ্যেও তাই। বাইরে থেকে যারা কাছাকাছি ভিতরের থেকে তাদের যদি ভেদ ঘটল, তা হলে ঐ ভেদটাই হল মূল বিপদ। যতক্ষণ সেটা আছে ততক্ষণ ইন্দ্ৰদেবের বাজকে, উনপঞ্চাশ পাবনের চেপেটাঘাতকে, বৈধ বা অবৈধ আন্দোলনের দ্বারা দমন করবার চেষ্টা করে ঝড়ের আন্দোলন কিছুতেই থামানো যায় না । আমরা যখন বলি স্বাধীনতা চাই তখন কী চাই, সেটা ভেবে দেখা চাই। মানুষ যেখানে সম্পূর্ণ একলা সেইখানে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন। সেখানে তার কারও সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ নেই, কারও কাছে কোনো দায়িত্ব নেই, কারও প্রতি কোনো নির্ভর নেই, সেখানে তার স্বাতন্ত্র্যে লেশমাত্র হস্তক্ষেপ করবার কোনো মানুষই নেই। কিন্তু মানুষ এ স্বাধীনতা কেবল যে চায় না তা নয়, পেলে বিষম দুঃখ বোধ করে। রবিনসন ক্রুসো তার জনহীন দ্বীপে যতখন একেবারে একলা ছিল ততখন সে একেবারে স্বাধীন ছিল । যখনই ফ্রাইডে এল তখনই তার সেই একান্ত স্বাধীনতা চলে গেল । তখন ফ্রাইডের সঙ্গে তার একটা পরস্পর-সম্বন্ধ বেধে গেল । সম্বন্ধ মাত্রেই অধীনতা । এমন-কি, প্ৰভুভুত্যের সম্বন্ধে প্রভুও ভূত্যের অধীন। কিন্তু রবিনসন ক্রুসো ফ্রাইডের সঙ্গে পরস্পর-দায়িত্বে জড়িত হয়েও নিজের স্বাধীনতার ক্ষতিজনিত দুঃখ কেন বোধ করে নি । কেননা, তাদের সম্বন্ধের মধ্যে ভেদের বাধা ছিল না । সম্বন্ধের মধ্যে ভেদ আসে কোথায় । যেখানে অবিশ্বাস আসে, ভয় আসে, যেখানে উভয়ে উভয়কে ঠকিয়ে জিততে চায়, যেখানে উভয়ের সঙ্গে উভয়ের ব্যবহারে সহজভাব থাকে না । ফ্রাইডে যদি হিংস্র বর্বর অবিশ্বাসী হত তা হলে তার সম্বন্ধে রবিনসন ক্রুসোর স্বাধীনতা নষ্ট হত। যার সঙ্গে আমার সম্বন্ধের পূর্ণতা নেই, অর্থাৎ যার প্রতি আমি উদাসীন, সে আমাকে টেনে রাখে না, কিন্তু তাই বলেই যে তারই সম্পর্কে আমি স্বাধীনতার যথার্থ আনন্দ ভোগ করি তা নয় । যার সঙ্গে আমার সম্বন্ধের পূর্ণতা, যে আমার পরম বন্ধু, সুতরাং যে আমাকে বঁধে, আমার চিত্ত তারই সম্বন্ধের মধ্যে স্বাধীনতা পায়, কোনো বাধা পায় না। যে স্বাধীনতা সম্বন্ধহীনতায় সেটা নেতিসূচক, সেই শূন্যতামূলক স্বাধীনতায় মানুষকে পীড়া দেয়। এর কারণ হচ্ছে, অসম্বন্ধ মানুষ সত্য নয়, অন্যের সঙ্গে - সকলের সঙ্গে সম্বন্ধের ভিতর দিয়েই সে নিজের সত্যতা উপলব্ধি করে । এই সত্যতা-উপলব্ধির বাধায় অর্থাৎ সম্বন্ধের ভেদে, অসম্পূর্ণতায়, বিকৃতিতেই তার স্বাধীনতার বাধা। কেননা, ইতিসূচক স্বাধীনতাই মানুষের যথার্থ স্বাধীনতা । মানুষের গার্হস্থ্যের মধ্যে বা রাজ্যের মধ্যে বিপ্লব বাধে। কখন, না, যখন পরম্পরের সহজ সম্বন্ধের বিপর্যয় ঘটে । যখন ভাইদের মধ্যে সন্দেহ বা ঈর্ষা বা লোভ প্ৰবেশ করে তাদের সম্বন্ধকে পীড়িত করতে থাকে- তখন তারা পরস্পরের মধ্যে বাধা পায়, কেবলই ঠোকর খেয়ে খেয়ে পড়ে, তাদের জীবনযাত্রার প্রবাহ পদে পদে প্ৰতিহত হয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে । তখন পরিবারে বিপ্লব ঘটে । রাষ্ট্রবিপ্লবও সম্বন্ধভেদের বিপ্লব । কারণ সম্বন্ধভেদেই অশান্তি, সেই অশান্তিতেই স্বাধীনতার ক্ষতি । আমাদের ধর্মসাধনাতেও কোন মুক্তিকে মুক্তি বলে। যে মুক্তিতে অহংকার দূর করে দিয়ে বিশ্বের সঙ্গে চিত্তের পূর্ণ যোগ সাধন করে । তার কারণ, বিশ্বের সঙ্গে যোগেই মানুষ সত্যএইজন্যে সেই সত্যের মধ্যেই মানুষ যথার্থ স্বাধীনতা পায়। আমরা একান্ত স্বাধীনতার শূন্যতাকে চাই