পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর Gos নে, আমরা ভেদ ঘুচিয়ে দিয়ে সম্বন্ধের পরিপূর্ণতাকে চাই, তাকেই বলি মুক্তি । যখন দেশের স্বাধীনতা চাই, তখন নেতিসূচক স্বাধীনতা চাই নে, তখন দেশের সকল লোকের সঙ্গে সম্বন্ধকে যথাসম্ভব সত্য বাধামুক্ত করতে চাই। সেটা হয় ভেদের কারণ দূর করে দিয়ে, কিন্তু সে কারণ ভিতরেও থাকতে পারে, বাইরেও থাকতে পারে । আমরা পশ্চিমের ইতিহাসে পড়েছি, সেখানকার লোকেরা স্বাধীনতা চাই বলে প্ৰায় মাঝে মাঝে কোলাহল তুলেছে। আমরাও সেই কোলাহলের অনুকরণ করি, আমরাও বলি আমরা স্বাধীনতা চাই। আমাদের এই কথাটি স্পষ্ট করে বুঝতে হবে যে, য়ুরোপ যখন বলেছে স্বাধীনতা চাই তখন বিশেষ অবস্থায় বিশেষ কারণে তার সমাজদেহের মধ্যে ভেদের দুঃখ ঘটেছিলসমাজব্বতী লোকদের মধ্যে কোনো-না-কোনো বিষয়ে কোনো-না-কোনো আকারে সম্বন্ধের বিচ্ছেদ বা বিকৃতি ঘটেছিল, সেইটেকে দূর করার দ্বারাই তারা মুক্তি পেয়েছে। আমরাও যখন বলি স্বাধীনতা চাই তখন ভাবতে হবে কোন ভেদটা আমাদের দুঃখ-অকল্যাণের কারণ- নইলে স্বাধীনতা শব্দটা কেবল ইতিহাসের বুলি-রূপে ব্যবহার করে কোনো ফল হবে না। যারা ভেদকে নিজেদের মধ্যে ইচ্ছা করে পোষণ করে তারা স্বাধীনতা চায়। এ কথার কোনো অর্থই নেই । সে কেমন হয়, না, মেজোবউ বলছেন যে তিনি স্বামীর মুখ দেখতে চান না, সন্তানদের দূরে রাখতে চান, প্রতিবেশীদের সঙ্গে মেলামেশা করতে চান না, কিন্তু বড়োবিউয়ের হাত থেকে ঘরকারনা নিজের হাতে কেড়ে নিতে চান । য়ুরোপের কোনো কোনো দেশে দেখেছি। রাষ্ট্রবিপ্লব ঘটে তার থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থার উদভাবন হয়েছে। গোড়াকার কথাটা এই যে, তাদের মধ্যে শাসিত ও শাসয়িতা এই দুই দলের মধ্যে ভেদ ঘটেছিল। সে ভেদ জাতিগত ভেদ নয়, শ্রেণীগত ভেদ । সেখানে এক দিকে রাজা ও রাজপুরুষ, অন্য দিকে প্ৰজা, যদিচ একই জাতের মানুষ তবু তাদের মধ্যে অধিকারের ভেদ অত্যন্ত বেশি হয়ে উঠেছিল । এইজন্যে তাদের বিপ্লবের একটি মাত্র কাজ ছিল, এই শ্রেণীগত ভেদটাকে রাষ্ট্রনৈতিক সেলাইয়ের কলে বেশ পাকারকম সেলাই করে ঘুচিয়ে দেওয়া । আজ আবার সেখানে দেখছি, আর-একটা বিপ্লবের হাওয়া বইছে । খোজ করতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে বাণিজ্যক্ষেত্রে যারা টাকা খাটাচ্ছে, আর যারা মজুর খাটছে, তাদের মধ্যে অধিকারের ভেদ অত্যন্ত বেশি । এই ভেদে পীড়া ঘটায়, সেই পীড়ায় বিপ্লব । ধনীরা ভীত হয়ে উঠে। কমীরা যাতে ভালো বাসস্থান পায়, যাতে তাদের ছেলে।পুলেরা লেখাপড়া শিখতে পারে, যাতে তারা সকল বিষয়ে কতকটা পরিমাণে আরামে থাকে, দয়া করে মাঝে মাঝে সে চেষ্টা করে, কিন্তু তবু ভেদ যে রয়ে গেল । ধনীর অনুগ্রহের ছিটেফোটায় সেই ভেদ তো ঘোচে না, তাই আপদও মিটতে চায় না । বহুকাল হল ইংলন্ড থেকে একদল ইংরেজ আমেরিকায় গিয়ে বসতি করে । ইংলন্ডের ইংরেজ সমুদ্রপার থেকে আমেরিকার ইংরেজের উপর শাসন বিস্তার করেছিল ; এই শাসনের দ্বারা সমুদ্রের দুই পারের ভেদ মেটে নি । এক্ষেত্রে নাড়ির টানের চেয়ে দড়ির টানটাই প্ৰবল হওয়াতে বন্ধন জোর করে ছিড়ে ফেলতে হয়েছিল । অথচ এখানে দুই পক্ষই সহােদর ভাই । একদিন ইটালিতে অস্ট্রিয়ান ছিল রাষ্ট্রের মুড়োয়, আর ইটালিয়ান ছিল ল্যােজায় । অথচ ল্যােজায় মুড়োয় প্রাণের যোগ ছিল না । এই প্রাণহীন বন্ধন ভেদকেই দুঃসহ রূপে প্ৰকাশ করেছিল। ইটালি তার থেকে মুক্তিলাভ করে সমস্যার সমাধান করেছে। তা হলে দেখা যাচ্ছে ভেদের দুঃখ থেকে, ভেদের অকল্যাণ থেকে মুক্তিই হচ্ছে মুক্তি । এমন-কি, আমাদের দেশের ধর্মসাধনার মূল কথাটা হচ্ছে ঐ- তাতে বলে, ভেদবুদ্ধিতেই অসত্য, সেই ভেদবুদ্ধি ঘুচিয়ে দিলেই সত্যের মধ্যে আমাদের পরিত্ৰাণ । কিন্তু পূর্বেই বলেছি বিধাতার পরীক্ষাশালায় সব পরীক্ষাথীর একই প্রশ্ন নয়। ভেদ এক রকম নয়। এক পায়ে খড়ম আর-এক পায়ে বুট, সে এক রকমের ভেদ ; এক পা বড়ো আর-এক পা ছোটাে, সে আর-এক রকমের ভেদ ; পায়ের হাড় ভেঙে গিয়ে পায়ের এক অংশের সঙ্গে অন্য অংশের বিচ্ছেদ, সে অন্য রকমের ভেদ ; এই সব-রকম ভেদাই স্বাধীনশক্তিযোগে চলাফেরা করায় বাধা দেয় । কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন ভেদের প্রতিকার ভিন্ন রকমের । খডম-পায়ের কাছ থেকে তার প্রশ্নের উত্তর চুরি করে নিয়ে