পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর VOw আমি পূর্বে অন্যত্র বলেছি, ধর্ম যাদের পৃথক করে তাদের মেলবার দরজায় ভিতর দিক থেকে আগল দেওয়া । কথাটা পরিষ্কার করে বলবার চেষ্টা করি। সকলেই বলে থাকে, ধর্ম শব্দের মূল অর্থ হচ্ছে যা আমাদের ধারণ করে । অর্থাৎ, আমাদের যে-সকল আশ্রয় ধ্রুব তারা হচ্ছে ধর্মের অধিকারভুক্ত । তাদের সম্বন্ধে তর্ক নেই। এই সকল আশ্রয়ের কোনো পরিবর্তন ঘটে না । এদের সঙ্গে ব্যবহারে যদি চঞ্চলতা করি, কথায় কথায় যদি মত বদল ও পথ বদল করতে থাকি, তা হলে র্বাচি (FN | কিন্তু সংসারের এমন একটা বিভাগ আছে যেখানে পরিবর্তন চলছে, যেখানে আকস্মিকের আনাগোনার অন্ত নেই ; সেখানে নূতন নুতন অবস্থার সম্বন্ধে নুতন করে বারে বারে আপস-নিম্পত্তি না করলে আমরা বঁচি নে । এই নিত্যপরিবর্তনের ক্ষেত্রে ধ্রুবকে অধুবের জায়গায়, অধ্রুবকে ধুবের জায়গায় বসাতে গেলে বিপদ ঘটবেই । যে মাটির মধ্যে গাছ শিকড় চালিয়ে দাড়িয়ে থাকে শিকড়ের পক্ষে সেই ধ্রুব মাটি খুব ভালো, কিন্তু তাই বলে ডালপালাগুলোকেও মাটির মধ্যে পুঁতে ফেলা কল্যাণকর নয়। পৃথিবী নিত্য আমাকে ধারণ করে ; পৃথিবী ধর্মের মতো ধ্রুব হলেই আমার পক্ষে ভালো, তার নড়াচড় হতে থাকলেই সর্বনাশ । আমার গাড়িটাও আমাকে ধারণ করে ; সেই ধারণ ব্যাপারটাকে যদি ধ্রুব করে তুলি তা হলে গাড়ি আমার পক্ষে পৃথিবী হবে না, পিজারে হবে । ‘অবস্থা বুঝে আমাকে পুরোনো গাড়ি বেচিতে হয় বা মেরামত করতে হয়, নতুন গাড়ি কিনতে হয় বা ভাড়া করতে হয়, কখনো-বাগাড়িতে ঢুকতে হয়, কখনো-বাগাড়ি থেকে বেরোতে হয়, আর গাড়িটা কাত হবার ভাব দেখালে তার থেকে লাফিয়ে পড়বার পূর্বে বিধান নেবার জন্যে ভাটপাড়ায় সইস পাঠাতে হয় না। ধর্ম যখন বলে “মুসলমানের সঙ্গে মৈত্রী করো’। তখন কোনো তর্ক না করেই কথাটাকে মাথায় করে নেব । ধর্মের এ কথাটা আমার কাছে মহাসমুদ্রের মতোই নিত্য । কিন্তু ধর্ম যখন বলে “মুসলমানের ছোওয়া অন্ন গ্ৰহণ করবে না।” তখন আমাকে প্রশ্ন করতেই হবে, কেন করব না । এ কথাটা আমার কাছে ঘড়ার জলের মতো অনিত্য, তাকে রাখব কি ফেলব সেটার বিচার যুক্তির দ্বারা । যদি বল এ-সব কথা স্বাধীনবিচারের অতীত, তা হলে শাস্ত্রের সমস্ত বিধানের সামনে দাড়িয়েই বলতে হবে, বিচারের যোগ্য বিষয়কে যারা নির্বিচারে গ্ৰহণ করে তাদের প্রতি সেই দেবতার ধিক্কার আছে ধিয়ো যো নঃ প্ৰচোদয়াৎ- যিনি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি প্রেরণ করেন । তারা পাণ্ডাকে দেবতার চেয়ে বেশি ভয় ও শ্রদ্ধা করে, এমনি করে তারা দেবপূজার অপমান করতে কুষ্ঠিত হয় না । সংসারের যে ক্ষেত্রটা বুদ্ধির ক্ষেত্র, সেখানে বুদ্ধির যোগেই মানুষের সঙ্গে মানুষের সত্যমিলন সম্ভবপর। সেখানে অবুদ্ধির উৎপাত বিষম বাধা । সে যেন মানুষের বাসার মধ্যে ভূতুড়ে কাণ্ড । কেন, কী বৃত্তান্ত, বলে ভূতের কোনো জবাবদিহি নেই। ভূত বাসা তৈরি করে না, বাসা ভাড়া দেয় না, বাসা ছেড়েও যায় না । এতবড়ো জোর তার কিসের । না, সে বাস্তব নয়, অথচ আমার ভীরু মন তাকে বাস্তব বলে মেনে নিয়েছে। প্রকৃত বাস্তব যে সে বাস্তবের নিয়মে সংযত ; যদি-বা সে বাড়ি-ভাড়া নাও কবুল করে, অন্তত সরকারি ট্যাক্সো দিয়ে থাকে । অবাস্তবকে বাস্তব বলে মানলে তাকে জ্ঞানের কোনো নিয়মে পাওয়া যায় না । সেইজন্যে কেবল বুক দূরদুর করে, গা ছমছম করে, আর বিনা বিচারে মেনেই চলি । যদি কেউ প্রশ্ন করে ‘কেন, জবাব দিতে পারি নে, কেবল পিঠের দিকে বুড়ো-আঙুলটা দেখিয়ে দিয়ে বলি, ঐ যে ! তার পরেও যদি বলে “কই যে, তাকে নাস্তিক বলে তাড়া করে যাই । মনে ভাবি, গোয়ারটা বিপদ ঘটালে বুঝি- ভূতকে অবিশ্বাস করলে যদি সে ঘাড় মটকে দেয় ! তবুও যদি প্রশ্ন ওঠে "কেন তা হলে উত্তরে বলি, “আর যেখানেই কেন খাটাও এখানে কেন খাটাতে এসো না বাপু, মানে মানে বিদায় হও- মরবার পরে তোমাকে পোড়াবে কে সে ভাবনাটা ভেবে রেখে দিয়ো ।” চিত্তরাজ্যে যেখানে বুদ্ধিকে মানি সেখানে আমার স্বরাজ ; সেখানে আমি নিজেকে মানি, অথচ সেই মানার মধ্যে সর্বদেশের ও চিরকালের মানবচিত্তকে মানা আছে। অবুদ্ধিকে যেখানে মানি সেখানে এমন একটা সৃষ্টিছাড়া শাসনকে মানি যা না। আমার না। সর্বমানবের । সুতরাং সে একটা কারাগার, সেখানে কেবল আমার মতো হাত-পা-বাধা এক কারায় অবরুদ্ধ অকালজরাগ্রস্তাদের সঙ্গেই আমার S RE \cdo