পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

कढ्ट्र Ve S \S) আৰ্যদ্বিজদের পক্ষে সত্য পদার্থ ছিল- তার শিক্ষা, দীক্ষা, ব্ৰহ্মচর্য গুরুগৃহবাস, সমস্তই তখনকার কালের ভারতবর্ষীয় আৰ্যদের মধ্যে প্রচলিত শ্ৰেষ্ঠ আদর্শগুলিকে গ্ৰহণ করবার পক্ষে উপযোগী ছিল । কিন্তু যে-সকল উচ্চ আদর্শ আধ্যাত্মিক, যার জন্যে নিয়তজাগরকে চিৎশক্তির দরকার, সে তো মৃত পদার্থের মতো কঠিন আচারের পৈতৃক সিন্ধুকের মধ্যে বন্ধ করে রাখবার নয়, সেইজন্যেই স্বভাবতই উপনয়নপ্ৰথা এখন প্ৰহসন হয়ে দাড়িয়েছে। তার কারণ, উপনয়ন যে আদর্শের বাহন ও চিহ্ন সেই আদর্শই গেছে। সরে । ক্ষত্রিয়েরও সেই দশা ; কোথায় যে সে, তাকে খুঁজে পাওয়া শক্ত । যারা ক্ষত্ৰিয়বৰ্ণ বলে পরিচিত, জাতকর্ম বিবাহ প্রভৃতি অনুষ্ঠানের সময়েই তারা ক্ষত্রিয়ের কতকগুলি পুরাতন আচার পালন করে মাত্র । এ দিকে শাস্ত্ৰে বলছেন : স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পর্যধর্মে ভয়াবহঃ । এ কথাটার প্রচলিত অর্থ এই দাড়িয়েছে যে, যে বর্ণের শাস্ত্ৰবিহিত যে ধর্ম তাকে তাই পালন করতে হবে । এ কথা বললেই তার তাৎপর্য এই দাড়ায় যে, ধর্ম-অনুশাসনের যে অংশটুকু অন্ধভাবে পালন করা চলে তাই প্ৰাণপণে পালন করতে হবে, তার কোনো প্রয়োজন থাক আর নাই থােক, তাতে অকারণে মানুষের স্বাধীনতার খর্বতা ঘটে ঘটুক, তার ক্ষতি হয় হােক । অন্ধ আচারের অত্যাচার অত্যন্ত বেশি তার কাছে ভালোমন্দর আন্তরিক মূল্যবোধ নেই। তাই যে শুচিবায়ুগ্ৰন্ত মেয়ে কথায় কথায় স্নান করতে ছোটে সে নিজের চেয়ে অনেক ভালো লোককে বাহ্যশুচিতার ওজনে ঘূণাভাজন মনে করতে দ্বিধা বোধ করে না । বস্তুত তার পক্ষে আন্তরিক সাধনার কঠিনতর প্রয়াস অনাবশ্যক । এইজন্যে অহংকার ও অন্যের প্রতি অবজ্ঞায় তার চিত্তের অশুচিতা ঘটে । এই কারণে আধুনিক কালে যারা বুদ্ধিবিচার জলাঞ্জলি দিয়ে সমাজকর্তাদের মতে স্বধর্ম পালন করে তাদের ঔদ্ধত্য এতই দুঃসহ, অথচ এত নিরর্থক । অথচ জাতিগত স্বধৰ্ম পালন করা খুবই সহজ যেখানে সেই স্বধর্মের মধ্যে চিত্তবৃত্তির স্থান নেই। বংশানুক্রমে হাড়ি তৈরি করা, বা ঘানির থেকে তেল বের করা, বা উচ্চতর বর্ণের দাস্যবৃত্তি করা কঠিন নয়- বরং তাতে মন যতই মরে যায় কাজ ততই সহজ হয়ে আসে । এই সকল হাতের কাজেরও নূতনতর উৎকর্ষ সাধন করতে গেলে চিত্ত চাই। বংশানুক্রমে স্বধৰ্ম পালন করতে গিয়ে তার উপযুক্ত চিত্তও বাকি থাকে না, মানুষ কেবল যন্ত্র হয়ে একই কর্মের পুনরাবৃত্তি করতে থাকে । যাই হােক, আজ ভারতে বিশুদ্ধভাবে স্বধর্মেটিকে আছে। কেবল শূদ্রেরা । শূদ্ৰত্বে তাদের অসন্তোষ নেই। এইজন্যেই ভারতবর্ষের-নিমকে-জীৰ্ণ দেশে-ফেরা ইংরেজ-গৃহিণীর মুখে অনেকবার শুনেছি, স্বদেশে এসে ভারতবর্ষের চাকরের অভাব তারা বড়ো বেশি অনুভব করে । ধর্মশাসনে পুরুষানুক্রমে যাদের চাকর বানিয়েছে তাদের মতো চাকর পৃথিবীতে কোথায় পাওয়া যাবে । লাথিবঁটা-বর্ষণের মধ্যেও তারা স্বধৰ্মরক্ষা করতে কুষ্ঠিত হয় না। তারা তো কোনোকালে সম্মানের দাবি করে নি, পায়ও নি, তারা কেবল শূদ্রধর্ম অত্যন্ত বিশুদ্ধভাবে রক্ষা করেই নিজেকে কৃতাৰ্থ মনে করেছে। আজ যদি তারা বিদেশী শিক্ষায় মাঝে মাঝে আত্মবিস্মৃত হয় তবে সমাজপতি তাদের স্পর্ধা সম্বন্ধে আক্রোশ প্রকাশ করে । স্বধৰ্মরত শূদ্রের সংখ্যাই ভারতবর্ষে সব চেয়ে বেশি, তাই এক দিক থেকে দেখতে গেলে ভারতবর্ষ শূদ্রধর্মেরই দেশ। তার নানা প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া গেছে। এই অতি প্ৰকাণ্ড শূদ্রধর্মের জড়িত্বের ভারাকর্ষণে ভারতের সমস্ত হিন্দুসম্প্রদায়ের মাথা হেঁট হয়ে আছে। বুদ্ধিসাধ্য জ্ঞানসাধ্য চারিত্রশক্তিসাধ্য যে-কোনো মহাসম্পদলাভের সাধনা আমরা আজ করতে চাই তা এই প্রবল শূদ্ৰত্বভার ঠেলে তবে করতে হবে- তার পরে সেই সম্পদকে রক্ষা করবার ভারও এই অসীম অন্ধতার হাতে সমৰ্পণ করা ছাড়া আর উপায় নেই। এই কথাই আমাদের ভাববার কথা । এই শূদ্রপ্রধান ভারতবর্ষের সব চেয়ে বড়ো দুৰ্গতির যে ছবি দেখতে পাই সেই পরম আক্ষেপের কথাটা বলতে বসেছি । প্ৰথমবারে যখন জাপানের পথে হংকঙের বন্দরে আমাদের জাহাজ লাগল, দেখলুম। সেখানে ঘাটে একজন পাজাবি পাহারাওয়ালা অতি তুচ্ছ কারণে একজন চৈনিকের বেণী ধরে তাকে লাথি মারলে । আমার মাথা হেঁট হয়ে গেল। নিজের দেশে রাজভৃত্যের-লাঞ্ছন-ধারী কর্তৃক স্বদেশীর এরকম