পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কর্মযজ্ঞ হিতসাধন-মণ্ডলীর প্রথম সভাধিবেশনে কথিত বক্তৃতার সারমর্ম সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তার জাতকর্ম-উৎসব করতে হয় ; কিন্তু, মানুষের কোনো শুভানুষ্ঠানের বেলায় আমরা এ নিয়ম পালন করি না- তার জন্মের পূর্বে আশার সঞ্চারটুকু নিয়েই আমরা উৎসব করি । আজকের অনুষ্ঠানপত্রে লেখা আছে যে, হিতসাধন-মণ্ডলীর উদ্যোগে এ সভা আহুত, কিন্তু বস্তুত কোনো মণ্ডলী তো এখনো গড়া হয় নি- আজকের সভা কেবলমাত্র আশার আমন্ত্রণ নিয়ে এসেছে । তর্ক যুক্তি বিচার বিবেচনা সে-সমস্ত পথে চলতে চলতে হবে- কিন্তু যাত্রার আরম্ভে পাথেয় সংগ্ৰহ করা চাই, আশাই তো সেই পাথেয় । দীর্ঘকাল নৈরাশ্যের মধ্যে আমরা যাপন করেছি । অন্যান্য দেশের সৌভাগ্যের ইতিহাস আমাদের সামনে খোলা । তারা কেমন করে উন্নতির দিকে চলেছে সে সমস্তই আমাদের জানা । কিন্তু তার থেকে আমাদের মনে কোনো আশার সঞ্চার হয় নি ; উলটে আমরা জেনেছিলুম যে, যেহেতু তারা প্রবল তাই তারা প্ৰবল, যেহেতু আমরা দুর্বল তাই আমরা দুর্বল, এর আর নড়াচড় নেই। এই বিশ্বাস অস্থিমজ্জায় প্রবেশ করে অবসাদে আমাদের অকৰ্মণ্য করে তুলেছে। দেশ জুড়ে কাজের ক্ষেত্র অথচ আমরা উদাসীন- তার কারণ এ নয় যে, আমাদের স্বাভাবিক দেশগ্ৰীতি নেই। বেদনায় বুক ভরে উঠেছে- তবু যে প্ৰতিকারের চেষ্টা করি নে তার একমাত্র কারণ, মনে আশা নেই। কী পরিমাণ কাজ আমাদের সামনে আছে তার তালিকাটি আজ দেখা গেল, ভালোই হল । তার পরে দেশের মধ্যে করা সেবক আছেন এবং তারা কিরকম সাড়া দিলেন যদি জানতে পারি সেও ভালো । কিন্তু সব চেয়ে যেটি বোঝা গেল সেটি হচ্ছে এই যে, সমস্ত দেশের অন্তরের আশা আজি বাহিরে আকারগ্রহণের জন্য ব্যাকুল । সম্মুখে দুৰ্গম পথ । সেই পথের বাধা অতিক্রম করবার মতো পাথেয় এবং উপায় এই নূতন উদ্যোগের আছে কি নেই, তা আমি জানি না। কিন্তু প্ৰাণের ভিতরে আশা বলছে- না, মরবি না, বঁাচরই এবং বঁাচাবই । এ আশা তো কোনোমতেই মরবার নয়, সে যে একেবারে প্রাণের মর্মনিহিত । যদিচ মরবার লক্ষণই দেখছি- হিন্দুর জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে, দুঃখদুৰ্গতির ডালপালা বাড়ছে, তবু প্ৰাণের ভিতর আশা এই যে, বীচব, বঁাচতেই হবে, কোনোমতেই মরিব না । জীবনের আরম্ভ বড়ো ক্ষীণ । যে-সব জিনিস নিজীব তাকে এক মুহুর্তেই ফরমায়েশমত ইট-কাঠি জোগাড় করে প্রকাণ্ড করে তোলা যেতে পারে, কিন্তু প্ৰাণের উপরে তো সে হুকুম চলে না। প্ৰাণ পরমদুর্বলরাপেই আপনার প্রথম পরিচয় দিয়ে থাকে- সে তো অণু আকারেই দেখা দেয়, অথচ তারই মধ্যে অনন্তকালের সত্তা লুকিয়ে থাকে । অতএব আজ আমাদের আয়োজন কতটুকুই বা, কজন লোকেরই বা এতে উৎসাহ- এ-সব কথা বলবার কথা নয় । কেননা, বাইরের আয়োজন ছোটো, অন্তরের আশা বড়ো । আমরা কতবার এরকম সভাসমিতির আয়োজন করেছি এবং কতবারই অকৃতাৰ্থ হয়েছি- এ কথাও আলোচ্য নয় ; ফিরে ফিরে যে এরকম চেষ্টা নানা আকারে দেখা দিয়েছে তার মানেই আমাদের আশা মরতে চায় না, তারও মানে প্ৰাণ আছে । প্ৰতিদিন আমাদের কত শুভচেষ্টা মরেছে। এ কথা প্ৰত্যক্ষ হলেও কখনোই সত্য নয় ; সত্য এই যে শুভচেষ্টা মরে নি, এবং কোনো কালে মরতে পারে না । এক রাজার পর আর-এক রাজা মরে, কিন্তু রাজার মৃত্যু নেই। রামানন্দবাবু আমাদের সামনে কর্তব্যের যে তালিকা উপস্থিত করেছেন সে বৃহৎ । আমাদের সামৰ্থ্য যে কত অল্প তা তো আমরা জানি । যদি বাইরের হিসেব খতিয়ে দেখতে চাই, তা হলে কোনো ভরসা। থাকে না । কিন্তু প্ৰাণের বেহিসাবি আনন্দে সমস্ত অবসাদকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় । সেই আনন্দই হচ্ছে শক্তি- নিজের ভিতরকার সেই আনন্দময় শক্তির উপর আমাদের ভরসা রাখতে হবে । আপনার প্রতি আমাদের রাজভক্তি চাই। আমাদের অন্তরের মধ্যে যে রাজা আছেন তাকে শ্রদ্ধা করি না বলেই