পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VVOO রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী তো তার রাজত্ব তিনি চালাতে পারছেন না । তার কাছে খাজানা নিয়ে এসো ; বলো, হুকুম করো তুমি, প্ৰাণ দেব তোমার কাজে, প্ৰাণ দিয়ে প্ৰাণ পাব । আপনার প্রতি সেই রাজভক্তি প্ৰকাশ করবার দিন আজ উপস্থিত। , পৃথিবীর মহাপুরুষেরা জীবনের বাণী দিয়ে এই কথাই বলে গিয়েছেন যে, বাইরের পর্বতপ্রমাণ বাধাকে বড়ো করে দেখো না, অন্তরের মধ্যে যদি কণা-পরিমাণ শক্তি থাকে তার উপর শ্রদ্ধা রাখো । বিশ্বের সব শক্তি আমার, কিন্তু আমার নিজের ভিতরকার শক্তি যতক্ষণ না জাগে ততক্ষণ শক্তির সঙ্গে শক্তির যোগ হয় না । পৃথিবীতে শক্তিই শক্তিকে পায় । বিশ্বের মধ্যে যে পরম শক্তি সমস্ত সৃষ্টির ভিতর দিয়ে, ইতিহাসের ভিতর দিয়ে, আপনাকে বিচিত্ররূপে উদঘাটিত করে সার্থক করে তুলছেন, সেই শক্তিকে আপনার করতে না পারলে, সমস্ত জগতে এক শক্তিরূপে যিনি রয়েছেন তাকে সুস্পষ্টরূপে স্পর্শ করতে না পারলে, নৈরাশা আর যায় না, ভয় আর ঘোচে না । বিশ্বের শক্তি আমারই শক্তি এই কথা জানো । এই দুটােমাত্র ছোটাে চোখ দিয়ে লোকলোকান্তরে-উৎসারিত আলোকের প্রস্রবণধারাকে গ্রহণ করতে পারছি, তেমনি আপন খণ্ড-শক্তিকে উমীলিত করবা মাত্ৰই সকল মানুষের মধ্যে যে পাবামা শক্তি আছে সে শক্তি আমারই মধ্যে দেখব । আমরা এতদিন পর্যন্ত নানা ব্যর্থ চেষ্টার মধ্য দিয়ে চলেছি। চেষ্টারূপে যে তার কোনাে সফলতা নেই তা বলছি না। বস্তুত অবাধ সফলতায় মানুষকে দুর্বল করে এবং ফলের মূল্য কমিয়ে দেয় । আমাদের দেশ যে হাতড়ে বেড়াচ্ছে, গলা ভেঙে ডাকাডাকি করে মরছে, লক্ষ্যস্থানে গিয়ে পৌছে উঠতে পারছে না- এর জন্য নালিশ করব না । এই বারংবার নিস্ফলতার ভিতর দিয়েই আমাদের বের করতে হচ্ছে কোন জায়গায় আমাদের যথার্থ দুর্বলতা । আমরা এটা দেখতে পেলাম যে, যেখানেই আমরা নকল করতে গিয়েছি সেইখানেই ব্যর্থ হয়েছি । যে-সব দেশ বড়ো আকারে আমাদের সামনে রয়েছে সেখানকার কাজের রূপকে আমরা দেখেছি, কাজের উৎসকে তো দেখি নি । তাই মনে কেবল আলোচনা করছি, অন্য দেশ এইরকম করে অমুক বাণিজ্য করে ; এইরকম আয়োজনে অমুক প্রতিষ্ঠান গড়ে ; অন্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এত টাকাকড়ি, এত ঘরবাড়ি, এই নিয়ম ও পদ্ধতি- আমাদের তা নেই- এইজন্যই আমরা মরছি। আমরা আলাদিনের প্রদীপের উপর বিশ্বাস করি ; মনে করি যে, আমরাও সৌভাগ্যশালী হয়ে উঠব । কিন্তু জানি না, আলাদিনের প্রদীপ আস্ত জিনিসগুলো তুলে এনে কী ভয়ংকর বোঝা আমাদের কাধে চাপিয়ে দেবে- তখন তার ভার বইবে কে । বহিশচক্ষু মেলে। অন্য দেশের কর্মরূপকে আমরা দেখেছি, কিন্তু কর্তাকে দেখি নি- কেননা নিজের ভিতরকার কর্তৃশক্তিকে আমরা মেলাতে পারি নি । কর্মের বোঝাগুলোকে পরের কাছ থেকে ধার করে এনে বিপন্ন ও বার্থ হতেই হবে ; কর্তাকে নিজের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে পারলেই তখন কাজের উপকরণ খাটি, কাজের মূর্তি সত্য ও কাজের ফল অমোঘ হবে । আলাদিনের প্রদীপের ব্যাপার। আমাদের এখানে অনেক দেখেছি, সেইজন্যে এ দেশে যে জিনিসটা গোড়াতেই বড়ো হয়ে দেখা দেয় তাকে বিশ্বাস করি নে। আমরা যেন আকৃতিটাকে চক্ষের পলকে জাদুকরের গাছের মতো মস্ত করে তোলবার প্রলোভনকে মনে স্থান না দিই। সত্য আপন সত্যতার গৌরবেই ছোটাে হয়ে দেখা দিতে লজ্জিত হয় না । বড়ো আয়তনকে গ্ৰহণ করতে হলে, সেটাকে মিথ্যার কাছ থেকে পাছে ধার নিতে হয়। এই তার বিষম ভয় । লোকের চোখ ভোলাবার মোহে গোড়াতেই যদি মিথ্যার সঙ্গে তাকে সন্ধি করতে হয়, তা হলে এক রাত্রের মধ্যে যত বৃদ্ধিই তার হােক, তিন রাত্রের মধ্যে সে সমূলেন বিনশ্যতি । ঢাক-ঢোল বায়না দেবার পূর্বে এবং কাঠ-খড়ি জোগাড়ের গোড়াতেই, এ কথাটা যেন আমরা না ভুলি। যিনি পৃথিবীর একার্ধকে ধর্মের আশ্রয় দান করেছেন তিনি আস্তাবলে নিরাশ্রয় দারিদ্র্যের কোলে জন্মেছিলেন । পৃথিবীতে যা-কিছু বড়ো ও সার্থক তার যে কত ছোটাে জায়গায় জন্ম, কোন অজ্ঞাত লগ্নে যে তার সূত্রপাত, তা আমরা জানি নে- অনেক সময় মরে গিয়ে সে আপনার শক্তিকে প্ৰকাশমান করে । আমার এইটে বিশ্বাস যে, যে দরিদ্র সেই দারিদ্র্য জয়