পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

फांक VV) লোকেরা প্ৰধান সাক্ষী । আমাদিগকে অসংকোচে সত্য বলিতে হইবে, তার ফল আমাদের পক্ষে যত কঠিন এবং অন্যদের পক্ষে যত অপ্রিয় হউক । আমাদের বাণী প্ৰভুত্বের বাণী নয়, তার পশ্চাতে শস্ত্ৰবল নাই । আমরা সেই উচ্চ রাজতত্তে দাড়াই নাই যেখান হইতে দেশবিদেশ নতশিরে আদেশ গ্ৰহণ করে । আমরা রাজসভার বাহিরে সেই পথের ধারে ধুলার উপরে দাড়াইয়া আছি যে পথে যুগযুগান্তের যাত্রা চলিতেছে ; যে পথে অনেক জাতি প্ৰভাতে জয়ধ্বজা উড়াইয়া দিগদিগন্তে ধুলা ছড়াইয়া বাহির হইয়াছে, সন্ধ্যাবেলায় তারা ভগ্ন দণ্ড এবং জীর্ণ কচ্ছায় যাত্রা শেষ করিল ; কত সাম্রাজ্যের অহংকার ঐ পথের ধুলায় কালের রথচক্ৰতলে চুৰ্ণ হইয়া গেল, আজ তার সন-তারিখের ভাঙা টুকরাগুলা কুড়াইয়া ঐতিহাসিক উলট-পালটা করিয়া জোড়া দিয়া মরিতেছে । আমাদের বাণী বেদনার বাণী- সত্যের বলে যার বল, একদিন যাহা অন্য-সকল কলগৰ্জনের উদ্ধের্ব ইতিহাসবিধাতার সিংহাসনতলে আসিয়া পৌঁছিবে । একদিন ছিল যখন যুরোপ আপনি আত্মাকে খুজিতে বাহির হইয়াছিল । তখন নানা চিত্তবিক্ষেপের মধ্যেও সে এ কথা বুঝিয়াছিল যে, বাহিরের লাভের দ্বারা নয়, কিন্তু অন্তরের সত্য হইয়া মানুষ আপন চরম সম্পদ পায় । সে জানিত, এ লাভের মূল্য কেবল আমাদের মনগড়া নয়, কিন্তু ইহার মূল্য সেই পরম প্রেমের মধ্যে যাহা চিরদিন মানুষের সংসারের মধ্যে সচেষ্ট হইয়া আছে। তার পরে এমন দিন আসিল যখন বিজ্ঞান বহির্জগতের মহিমা প্ৰকাশ করিয়া দিল এবং য়ুরোপের নিষ্ঠাকে আত্মার দিক হইতে বস্তুর দিকে জোর করিয়া ছিনাইয়া লইল । মানুষের পক্ষে বিজ্ঞানের খুব একটা বড়ো তাৎপৰ্য আছে। প্রকৃতির নিয়মের সঙ্গে মানুষের জ্ঞানের সহযোগিতা আছে, বিজ্ঞান ইহাই প্ৰমাণ করে। প্রকৃতির নিয়মের সাহায্যে প্রাকৃতিকই নির্বাচনের অধীনতা কাটাইয়া মানুষ আপনি ধর্মবিবেকের স্বাধীন নির্বাচনের গৌরব লাভ করিতে পারে, ইহাই বিজ্ঞানের শিক্ষা । প্রকৃতি যে মানুষের পরিপূর্ণতালাভের পথে অন্তরায় নহে, প্রকৃতির সহিত সত্য ব্যবহার করিয়া। তবেই আমাদের চিন্ময়কে রূপদান করিয়া তাহার বাস্তুপ্ৰতিষ্ঠা করিতে পারি, য়ুরোপের প্ৰতি এই সত্য প্রচারের ভার আছে । বিজ্ঞান যেখানে সর্বসাধারণের দুঃখ এবং অভাব। -মোচনের কাজে লাগে, যেখানে তার দ্বান বিশ্বজনের কাছে গিয়া পৌঁছায়, সেইখানেই বিজ্ঞানের মহত্ত্ব পূর্ণ হয় । কিন্তু, যেখানে সে বিশেষ ব্যক্তি বা জাতিকে ধনী বা প্ৰবল করিয়া তুলিবার কাজে বিশেষ করিয়া নিযুক্ত হয়। সেখানেই তার ভয়ংকর পতন । কারণ, ইহার প্রলোভন এত অত্যন্ত প্ৰকাণ্ড রূপে প্রবল যে আমাদের ধর্মবুদ্ধি তার কাছে অভিভূত হইয়া পড়ে এবং স্বােজাত্য ও স্বাদেশিকতা প্রভৃতি বড়ো বড়ো নামের বর্ম পরিয়া নিজেরই শক্তির বিরুদ্ধে দাড়াইয়া লড়াই করে । ইহাতে আজ জগতের সর্বত্র এক জাতির সঙ্গে অন্য জাতির সম্বন্ধ দুর্বলের দিকে দালন-বন্ধনের দ্বারা ভারগ্রস্ত এবং প্রবলের দিকে হিংস্রতার অন্তহীন প্রতিযোগিতায় উদ্ধত হইয়া উঠিতেছে ; সকল দেশে যুদ্ধ ও যুদ্ধের উদযোগ নিত্য হইয়া উঠিয়াছে এবং পোলিটিকাল মহামারীর বাহন যে রাষ্ট্রনীতি তাহা নিষ্ঠুরতা ও প্ৰবঞ্চনার অন্তরে অন্তরে কলুষিত হইতে থাকিল । তথাপি এই আশা করি, য়ুরোপের এতদিনের তপস্যার ফল আজ বস্তুলোভের ভীষণ দ্বন্দ্বের মধ্যে পডিয়া পায়ের তলায় ধুলা হইয়া যাইবে না । আজিকার দিনের প্রচণ্ড সংকটের বিপাকে যুরোপ আর-কোনো একটা নূতন প্ৰণালী, আর-একটা নূতন রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থা খুঁজিয়া বেড়াইতেছে । কিন্তু বারংবার মৃত্যুর পাঠশালায় শিক্ষালাভের পরে যুরোপকে আজ না হয় তো আর-একদিন এ কথা মানিতেই হইবে যে, কেবল কার্যপ্ৰণালীর পিরামিড-নির্মাণের প্রতি আস্থা রাখা অন্ধ পৌত্তলিকতা ; তাহাকে এ কথা বুঝিতে হইবে, বাহিরের প্রণালীকে নয়, অন্তরের সত্যকে পাওয়া চাই ; এ কথা বুঝিতে হইবে যে, ক্রমাগতই বাসনা-হুতাগ্নির হাব্য সংগ্ৰহ করিতে থাকিলে একদিন জগদব্যাপী অগ্নিকাণ্ড না ঘটিয়া থাকিতে পারে না । একদিন জাগিয়া উঠিয়া যুরোপকে তার লুব্ধতা এবং উন্মত্ত অহংকারের সীমা বাধিয়া দিতে হইবে ; তার পরে সে আবিষ্কার করিতে পরিবে যে, উপকরণই যে সত্য তাহা নয়, Y NR || 8 NS