পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৬৩৬ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী অমৃতই সত্য । ঈর্ষার অন্ধতায় যুরোপের মহত্ত্ব অস্বীকার করিলে চলিবে না। তার স্থানসন্নিবেশ, তার জলবায়ু, তার জাতিসমবায়, এমনভাবে ঘটিয়াছে যে, সহজেই তার ইতিহাস শক্তি সৌন্দর্য এবং স্বাতন্ত্র্যাপরতায় সম্পদশালী হইয়া উঠিয়াছে। সেখানকার প্রকৃতিতে কঠোরতা এবং মৃদুতার এমন একটি সামঞ্জস্য আছে যে, তাহা এক দিকে মানবের সমগ্ৰ শক্তিকে দ্বন্দ্বে আহবান করিয়া আনে, আর-এক দিকে তাহার চিত্তকে অভিভূত করিয়া নিশ্চেষ্ট অদৃষ্টবাদে দীক্ষিত করে না । এক দিকে তাহা যুরোপের সন্তানদের চিত্তে এমন তেজের উদ্রেক করিয়াছে যে তাহদের উদ্যম ও সাহসের কোথাও আপনি দাবির কোনো সীমা স্বীকার করিতে চায় না ; অপর দিকে তাহাদের বুদ্ধিতে অপ্ৰমাদ, তাহদের কল্পনাবৃত্তিতে সুসংযম, তাহাদের সকল রচনায় পরিমিতি এবং তাহদের জীবনের লক্ষ্যের মধ্যে বাস্তবতাবোধের সঞ্চার করিয়াছে। তাহারা একে একে বিশ্বের গৃঢ় রহস্যসকল বাহির করিতেছে, তাহাকে মাপিয়া ওজন করিয়া আয়ত্ত করিতেছে ; তাহারা প্ৰকৃতির মধ্যে অন্তরতর যে-একটি ঐক্যতত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছে তাহা ধ্যানযোগে বা তর্কের বলে নয়- তাহা বাহিরের পর্দা ছিন্ন করিয়া, বৈচিত্র্যের প্রাচীর ভেদ করিয়া । তাহারা নিজের শক্তিতে রুদ্ধ দ্বার উদঘাটিত করিয়া প্রকৃতির মহাশক্তিভাণ্ডারের মধ্যে আসিয়া উত্তীর্ণ হইয়াছে এবং লুব্ধ হস্তে সেই ভাণ্ডার লুণ্ঠন করিতেছে। নিজের এই শক্তি সম্বন্ধে য়ুরোপের দম্ভ অত্যন্ত বাডিয়াছে বলিয়াই কোথায় যে তার নূ্যনতা তাহা সে বিচার করে না । বাহ্যপ্রকৃতির রূপ যে দেশে অতিমাত্র বৃহৎ বা প্ৰচণ্ড সে দেশে যেমন মানুষের চিত্ত তাহার কাছে অভিভূত হইয়া আত্মবিস্মৃত হয় তেমনি মানুষ নিজকৃত বস্তুসঞ্চয় এবং বাহ্যরচনার সামঞ্জস্য নষ্ট হইতে হইতে একদিন মানুষের সমৃদ্ধি ভয়ংকর প্রলয়ের মধ্যে ধুলায় লুটাইয়া পড়ে । রোম একদিন আপনি সাম্রাজ্যের বিপুলতার দ্বারাই আপনি বিহবল হইয়াছিল । বস্তুর অপরিমিত বৃহত্ত্বের কাছে তার সত্য যে প্রতিদিন পরাভূত হইতেছিল তাহা সে নিজে জানিতেই পারে নাই। অথচ সেদিন য়িহুদি ছিল রাষ্ট্রব্যাপারে পরতন্ত্র, অপমানিত । কিন্তু, সেই পরাধীন জাতির একজন অখ্যাতনামা অকিঞ্চন যে সত্যের সম্পদ উদঘাটিত করিয়া দিল তাঁহাই তো স্তুপাকার বস্তুসঞ্চায়ের উপরে জয়লাভ করিল। য়িহুদি উদ্ধত রোমকে এই কথাটুকু মাত্র স্মরণ করাইয়া দিয়াছিল যে, আপনি আত্মাকে তুমি আপন ধনের চেয়ে বড়ো করিয়া জানো । এই কথাটুকুতেই পৃথিবীর ইতিহাসে নৃতন যুগ আসিল । দরিদ্রের কথায় আপনার উপর মানুষের শ্রদ্ধা জন্মিল, আত্মাকে লাভ করিবার জন্য সে বাহির হইল । বাহিরে তাহার বাধা বিস্তর, তবু নিজের সঙ্গে লড়াই করিতে করিতে অমৃতলোকের দিব্যসম্পদ অর্জন করিবার জন্য সে অগ্রসর হইতেছিল । এমন সময়ে তাহার তপস্যা ভঙ্গ করিবার জন্য বাহিরের দিক হইতে আবার আসিল প্রলোভন । বাহিরের জগৎকে তার হাতে তুলিয়া দিবার জন্য বিজ্ঞান তার সমুখে আসিয়া দাড়াইল । যুরোপ আবার আত্মার চেয়ে আপন বস্তুসংগ্রহকে বড়ো করিয়া দেখিতে লাগিল । দেখিতে দেখিতে বস্তু চারি দিকে বাডিয়া চলিল । কিন্তু, ইহাই অসত্য । যেমন করিয়া যে নাম দিয়াই এই বাহিরকে মহীয়ান করিয়া তুলি না কেন, ইহা আমাদিগকে রক্ষা করিতে পরিবে না । ইহা ক্রমাগতই সন্দেহ, ঈৰ্ষা, প্ৰতিদ্বন্দ্বিতা, প্রতারণা, অন্ধ অহংকার এবং অবশেষে অপঘাতমৃত্যুর মধ্যে মানুষকে লইয়া যাইবেই ; কেননা মানুষের পক্ষে সকলের চেয়ে বড়ো সত্য এই যে ; তব্দে তৎ প্রেয়ো বিত্তাৎ অন্তরতরাং যদায়মাত্মা । অন্তরতর এই-যে আত্মা, বাহিরের সকল বিত্তের চেয়ে ইহা প্ৰিয় । যুরোপে ইতিহাস একদিন নূতন করিয়া আপনাকে যে সৃষ্টি করিয়াছিল, কোনো নূতন কার্যপ্ৰণালী, কোনো নূতন রাষ্ট্ৰতন্ত্রের মধ্যে তাহার মূলভিত্তি ছিল না । মানুষের আত্মা অন্য সব-কিছুর চেয়ে সত্য, এই তত্ত্বটি তাহার মনকে স্পর্শ করিবামাত্র তাহার সৃজনীশক্তি সকল দিকে জাগিয়া উঠিল । আদ্যকার ভীষণ দুদিনে য়ুরোপকে এই কথাই আর-একবার স্মরণ করিতে হইবে । নহিলে একটার পর আর-একটা মৃত্যুবাণ তাহাকে বাজিতে থাকিবে ।